অমর একুশ: বায়ান্নর সিঁড়িতে একাত্তর

- অনলাইন ডেস্ক
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৭
ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি জাতির ইতিহাস হলাে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। এ আন্দোলনের মধ্যদিয়েই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়াদের উপমহাদেশ থেকে বিদায় করতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার সাথে সাথে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর এর দুটি অংশের মাঝে ধর্মের মিল ছাড়া অন্যকোনাে মিল ছিল না। শুরু থেকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৪৭ থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাংলার ইতিহাসে পাকিস্তানের শােষণের বিরুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ।
স্বাধীন বাংলাদেশ ও এ উপমহাদেশে ৫২, ৭১ কেবল সংখ্যা বা সাল নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি-২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরও শুধু তারিখ নয়। এগুলো ইতিহাসের এক একটি বাঁক। কোনো সাল বা তারিখ আপনা আপনি আসেনি। প্রতিটিই রক্তভেজা উপাখ্যানে ভরা।
১৯৫২-এর ভাষা শহীদদের রক্তস্রোতে গেঁথে আছে বাঙালির মুক্তির গৌরবগাঁথা। ৫২’-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলার ছাত্রসমাজের আত্মদানে আসে মাতৃভাষার অধিকার। সেই দিনটি আজ বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবের স্মারক। বায়ান্ন এদেশের মানুষকে আত্মত্যাগের মন্ত্র শিখিয়ে সাহসী করেছে। সেই সাহস তাদের মহীয়ান করেছে একাত্তরে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন আমতলায় ছাত্রসভার সিদ্ধান্তক্রমে ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙলো। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকে। বিরতি পড়লেও সেই রক্তধারা আর থামেনি। ৬২-৬৬ তেও একুশকে ঘিরে রাজপথ উত্তপ্ত হয়েছে। তা ঊনসত্তরেও। ৬৯’-এর গণআন্দোলনের সর্বব্যাপী গণবিস্ফোরণ ঘটে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সেদিন খুলনায় পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ১১ দফার দাবীতে শুরু হওয়া আন্দোলন পূর্ণাঙ্গতা পায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ডঃ শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমাতে সরকার কারফিউ জারি করে। তা আন্দোলনকে আরো মাত্রা দেয়। এতে প্রমাণ হয় ’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রাম শুধু বাংলা ভাষার সংগ্রাম ছিল না। এর ব্যাপ্তি-বিস্তার কেবল এগোতেই থাকে। ’৫২ ও ’৬৯-এর রক্তস্নাত পথ বেয়ে একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি উত্তাপের পারদ ওঠে নতুন উচ্চতায়। মার্চ-ডিম্বেররে ইতিহাস সবারই জানা। সাত দশক আগে ১৯৫২-র একুশ ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট নির্মিত হয় তার তাৎক্ষণিক তাৎপর্য মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সীমবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালপরিক্রমায় এর তাৎপর্যের পরিধি বিস্তৃত হয়। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণশক্তি ছিল একুশের চেতনা।
যাবতীয় বিবেচনায় তাই একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষীদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার দিন। শুরুটা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে হলেও ক্রমেই তা পরিণতি পায় স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের সৈনিকরা দেশবাসীকে উপলব্ধি করাতে পেরেছিলেন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। সেই অর্থ বাঙালি তালাশ করে বহু রক্তে একাত্তরে ছিনিয়ে এনেছে মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্পর্শে জাতীয় জীবনে নৈতিকতা, পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র চেতনার বিকাশ এবং দারিদ্র্য মোচনের দ্বারা স্বনির্ভরশীলতা অর্জনের মধ্যে রয়েছে একুশের প্রকৃত প্রত্যয়। সেইসঙ্গে রয়েছে মাথা নত না করে এগিয়ে যাওয়ার দীক্ষাও। যা আজকের জন্যও জরুরি।
একুশের চেতনার মূল জায়গায় শুধু ভাষার দাবি ছিল না। এ দাবি ছিল গণতান্ত্রিক দাবি। আর এ গণতান্ত্রিক দাবির ধারাবাহিকতাতেই আন্দোলন হয়েছে, গণঅভু্ত্থান হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, একটা নতুন রাষ্ট্র হয়েছে। বাংলাদেশের অভু্ত্থান তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছি কিন্তু ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। দুঃখের বিষয় ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা নিজ দেশে যেন অনেকটা উপেক্ষিত! ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এক নয়। তাই বলে ইংরেজি চর্চা বর্জন করতে হবে তা কিন্তু নয়, বরং ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রেও ইংরেজি জানা যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলা জানা। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যেন ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক কিংবা ফেব্রুয়ারি মাস কেন্দ্রিক না হয়। সুতরাং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিতে হবে।
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি


