হারাচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:০০

জোবায়দা আক্তার জবা: ভাষা আসলে একটি অদ্ভুত প্রতীকী ব্যবস্থা, যেখানে সচেতনতার উপাদানগুলো, যেমন বহির্জগতের অভিজ্ঞতা, আমাদের চিন্তা, অনুভব ইত্যাদি সম্পর্কিত হয় মস্তিষ্কে ও স্নায়ুর কতোগুলো বিশেষ অঞ্চলের কাজের সঙ্গে। আমরা যখন কথা বলি তখন ক্রমাগতভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গগুলো চালিত হয় সমন্বিত হয়। ভাষা ব্যবহারের সময় অসংখ্য প্রতীকী শব্দ যখন একই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন একটি জটিল ধারণা বা চিন্তার সমন্বিত প্রবাহ এর সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হয়, যার উপাদানগুলো আবার প্রতীকী চেতনার নানা স্তরে, স্থান-কাল-ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে। ভাষা এমন এক অস্ত্র, একটি হাতিয়ার, যা আমাদের ভাবনা, কল্পনা, অভিজ্ঞতা, আকাক্সক্ষা, আবেগ বা যুক্তির সবধরনের অভিব্যক্তিকে ধারণ ও সঞ্চালিত করতে পারে। আমাদের ভাষা চিন্তার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টা খুবই সম্পর্কিত। ভাষার কথা বললে এটা সহজেই এসে যায়। মায়ের মুখের ভাষার অধিকারের জন্যে মানুষ লড়বে মানুষ লড়বে, এটা তো স্বাভাবিক বিষয়ই শুধু না চিরায়ত সত্য।

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগণের অনমনীয় লড়াইয়ের চিহ্ন হলেও এটা ছিলো সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখা ও ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও। সে জন্য একুশে ফেব্রয়ারি প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই একটি বহুমাত্রিক প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশই ঘটেছে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বস্তুত মাতৃভাষায় শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ভাব-প্রকাশের অধিকার বিশ্বের অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই এখন কার্যকর করতে পারছে না। অধিকাংশ ভাষাই এখন হুমকির সম্মুখীন।

অধিকাংশ ভাষা-ভাষী মানুষই বর্তমানে পরাজিত, বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রাণপণে চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের সে চেষ্টায় একটি প্রতীকী অবলম্বন। পৃথিবীর বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা হওয়ার সংগ্রাম আজ অবধি অব্যাহত। তারপেরেও বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা সর্বস্তরে হয়নি। এখন যে সংকটের মুখোমুখি সংগ্রামী বাংলা ভাষা তাহলো মান ভাষা তৈরি হয় আঞ্চলিক ভাষা থেকে। কিন্তু ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার এ সময়ে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা হুমকির মুখে। আমরা জানি প্রতি মুহূর্তে পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সব জাতি চেষ্টা করে তার ভাষার শব্দভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করতে। আমরাও হয়তো তাই চাই অথবা চাওয়া উচিত।

ইদানীং একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলছে- আঞ্চলিক ভাষা, যা বাংলা ভাষাকে রেখেছে সমৃদ্ধ। শব্দভাণ্ডার ভরপুর আর এ ভাষার মাঝে আছে বৈচিত্র্য। কিন্তু আজ সেই আঞ্চলিক ভাষা বিলুপ্তির সম্মুখীন। যার যার এলাকার ভাষা এলাকাবাসী ব্যবহার করত এখন প্রায় ভুলতে বসেছে। পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে শহর। শহুরে মানুষের ভাষা হবে পরিশুদ্ধ। আধুনিক যুগে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা একটা ট্রেন্ড। যার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজের পরিচিত দীর্ঘদিন প্রচলিত মুখের ভাষা প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। আমাদের গোপালগঞ্জের যে নিজস্ব ভাষা ছিল তা এখন চেষ্টা করলেও মনে করে বলতে বেশ সময় লাগে পাশাপাশি অনেক শব্দ হারিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম প্রায় অজ্ঞাত।

খুবই বৈচিত্র্যময় ছিল সে ভাষা, বাক্যে ছিল আলাদা টান আলাদা একটা স্টাইল। স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার, এখন আর শুনতে পাই না।
এ তোগে খলটে যাতিয়ারব না- এই তোদের বাসায় যেতে পারব না।
ওরে আল্লারে ডগ নামতিছে-হায় আল্লাহ! বৃষ্টি নামছে
তুই খাতি আসিস না ক্যা-তুমি খেতে আসো না কেন?
ভাইসাপ অলেন অলেন- ভাই নামেন নামেন।
এ ভাডি এ বুন্ডি কোহানে যাচ্ছির?- ওহে ভাই বোন কোথায় যাচ্ছ?
ভালঠেকতিছে না বিয়ানেরতিয়া- সকাল থেকে ভালো লাগছে না।

এ রকম হাজারো শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে কেউ আর বলে না, শুনতেও পাই না। সবাই যেন একটা ভাষায় আবৃত হয়ে গেছে। অথচ আঞ্চলিক ভাষার মধ্য দিয়ে একজন মানুষের পরিচয় ফুটে ওঠে। বোঝা যায় কার বাড়ি কোথায়। কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে আঞ্চলিক ভাষায় মানুষ যে পরিমাণ আপন হয় তেমন আর কিছুতেই হয় না। এই আঞ্চলিক ভাষা সংকটের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে কোনো জাতি সমৃদ্ধ হতে পারেনি। প্রতি মুহূর্তে ভাষার যে মধুরতা হ্রাস পাচ্ছে তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। আমাদের দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন এতে করে শব্দও ভিন্ন। কিন্তু এ ভাষাকে সর্বদা প্রচার মাধ্যমে ব্যবহার করলে বলার চর্চা করলে বৈচিত্র্য আসবে সমৃদ্ধ হবে বাংলা ভাষা। খুব শিগগির এমন দিন আসতে চলেছে নতুন প্রজন্ম এমন অনেক শব্দ আছে যেটা বুঝবেই না।

বর্তমানে ফেসবুক, নেট, ইংলিশ মিডিয়াম পড়াশুনা সব মিলিয়ে একটা খিচুড়ি অবস্থা। প্রজন্মতো ফেসবুক ইমো হোয়াটসআ্যপে মেসেজ কমেন্ট অনুসরণে কথা কেটে কেটে ছোট করে বলতে শুরু করেছে। কিছু কিছু আধেক ইংরেজি আধেক বাংলা আবার পাঁচ মিশালি বলে। দেশীয় নাটক সিনেমায় এখন আঞ্চলিক বাংলা পাওয়া দুস্তর। ইন্দোইউরোপীয় ভাষা থেকে আগত বাংলা না জানি আর কতদিন সমৃদ্ধ রাখতে পারব। হয়তো চাপা পড়ে যাবে এসব এলেবেলে ভাষার ছড়াছড়িতে। আমার আবেদন: ভাষাকে আরো নতুন কিছু সংযুক্ত করে বিস্তৃত করুন, কোনো একমুখী প্রচারে উ ত্ত হয়ে নিজেদের সর্বনাশ করবেন না। জনপ্রিয়তা অনুসরণ করে নয় সৃজনশীল ক্ষমতা দিয়ে অর্জন করুন বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার। কদর করতে যেন শিখি অমরি বাংলা ভাষা।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক


poisha bazar