বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোকে মিরাজ


  • আফতাব চৌধুরী
  • ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:২২

বিশ্ব মানবতার মুক্তি দিশারী মহানবী হজরত মুহম্মদ মোস্তফা (স.) এর জীবনের একটি বাস্তব ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী উজ্জ্বল ঘটনা শবে মিরাজ। ‘উরুজ’ অর্থ ওপরে ওঠা বা উত্থান। মূল ধাতু এ উরুজ থেকে এসেছে আরবি শব্দ মিরাজ। মিরাজ অর্থ সিঁড়ি, ঊর্ধ্বগমন, আরোহণ। আভিধানিক অর্থে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ কিংবা মহামিলন, আর ফারসি শব্দ অর্থ রাত। রাসূল (স.) এর ‘বোরাক’ যোগে সমজিদুল হারাম বাইতুল্লাহ থেকে জেরুজালেমের সমজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বলোকে ‘রফরফ’ যোগে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টির অনন্ত রহস্য অবলোকন, আল্লাহপাকের পরম সান্নিধ্য অর্জন এবং উভয় বন্ধুর বাক্যালাপকে ইসলামের পরিভাষায় মিরাজ বলা হয়। রাসূল (স.) এর নবুওয়তের দশম বর্ষে ৫০ বছর বয়সকালে রজব মাসের শেষের দিকে মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়।

পবিত্র কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াতে সমজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ এবং সূরা নাজমে ১৩ থেকে ১৮ নম্বর আয়াত এবং একই সূরার ৮ থেকে ১০ নম্বর আয়াতে নবীজির ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণের কথা উল্লেখ রয়েছে। মিরাজ সম্পর্কে হাদিস শরিফেও ৩১ জন সাহাবি থেকে বিশদ বিবরণ সংবলিত ৩২টি বর্ণনা এসেছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাণ্ডার যতই সমৃদ্ধ হচ্ছে, মহাশূন্য সম্পর্কে জটিলতার জট ততই খুলছে। ততই মিরাজুন্নবী (স.) কে চরম বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতার নিরিখে প্রমাণ করার দ্বার উš§ুক্ত হচ্ছে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করা, বিদ্যুৎ জাতীয় বাহনে যাওয়া, আলোর গতির চেয়ে দ্রুত যাওয়া, পাঁচ হাজার বছর চলার পথ মুহূর্তের মধ্যে অতিক্রম করা সত্যিই বিস্ময়কর।

এমন এক সময় সংঘটিত হয় মিরাজ, যার আগের সময়কে রাসূল (স.) ‘আমুল হুজন’ বা শোক, দুঃখের বছর বলেছেন। কেননা এ বছরই নবীজির পিতৃব্য আবু তালিব, পরম প্রিয় সহধর্মিণী বিবি খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। এ সঙ্কটময় সময়ে মক্কার অবিশ্বাসীরা তাদের নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং তায়েফে রাসূল (স.) যথেষ্ট লাঞ্ছনা-অবমাননার শিকার হন। এমন একটি মুহূর্তে আলাহপাক রাসূল (স.) কে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে সব দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করার জন্য সান্ত¡না দেন এবং এমন সব অধ্যাদেশ দান করেন, যা তাঁর ও তাঁর উম্মতের জন্য ছিল অপরিহার্য। কুরআনের অকাট্য তথ্য একজন মুসলমান মানতে বাধ্য। পবিত্র কুরআনে কল্পনার কোনো স্থান নেই। কুরআন ও হাদিস এমন আরো বাস্তব ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। যেমন হজরত মুসা (আঃ) দলবলসহ হেঁটে নীল নদ পার হওয়া। হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া। হজরত ঈসা (আঃ)-এর আকাশে আরোহণ এবং তাঁর পুনরায় দুনিয়াতে আগমন হওয়ার কথা। বিবি মরিয়মের স্বামী ব্যতীত পুত্রসন্তান লাভ। হজরত মুসা (আঃ)-এর উম্মতের জন্য আকাশ থেকে গায়েবি খাদ্য মান্না ও সালওয়া নামিয়ে দেওয়া, হজরত ঈসা (আঃ)-এর উম্মতের জন্য খাদ্যভর্তি খাঞ্চ ‘মায়িদাই’ আকাশ থেকে নামিয়ে দেওয়া, হজরত সোলাইমান (আঃ)Ñএর নির্দেশে বিশেষ কিতাবের জ্ঞানী এব ব্যক্তি ‘সাবা’ রাষ্ট্রের রানী বিলকিসের সিংহাসনকে চোখের পলকে ইয়ামন থেকে উঠিয়ে আনা (সূরা নামাল, আয়াত-৪০), ফেরেশতাদের প্রতিদিন আকাশে ওঠানামা করা এবং পৃথিবীর সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো কোনোটিকেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আর ফেরেশতাদের আকাশে ওঠা-নামার শক্তি দানকারী আল্লাহ তাঁর এক বিশেষ বান্দাকে ক্ষণিকের মধ্যে আকাশে ওঠানামার ব্যবস্থা করার কত না সহজ। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মহাকাশ অভিযান শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। এ অভিযানে প্রথম সফলতা আসে ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই। দুই লাখ বায়ান্ন হাজার মাইল ভ্রমণ শেষে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন। কিন্তু তার ১৪০০ বছর আগে রাসূল (স.) আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পাঁচ হাজার বছরের পথ মুহূর্তের মধ্যে ভ্রমণ করে ফিরে আসেন, যা জগতের চিন্তাশীল ও বিজ্ঞানীদের মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আজ মঙ্গলগ্রহেও বসবাসের চিন্তা করছে মানুষ, যার দূরত্ব পৃথিবী থেকে সাড়ে তিন কোটি মাইল। পৃথিবীর আকাশ থেকে এর নিকটবর্তী আকাশ পাঁচশ’ বছরের চলার পথ। এভাবে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত প্রত্যেক আকাশের মাঝে রয়েছে পাঁচশ বছর চলার পথ। এরপর সপ্তম আকাশের ওপর থেকেও রয়েছে পাঁচশ বছর চলার পথ। তার ওপর পানি, পানির ওপরে রয়েছে আল্লাহর আরশ। তাতে সমাসীন আছেন আল্লাহ। (বিশিষ্ট সাহাবি ইবনে মাসউদের বর্ণনা। রদ্দুল ইমাম দারিমি আল্লাল মুরিসি (৭৩ ও ৯০ পৃষ্ঠা)। এতে প্রমাণিত হয়, মাথার ওপর থেকে পাঁচ হাজার বছর চলার পথের দূরত্বে আরশের ওপরে রয়েছেন আল্লাহ। ওই দূরত্ব মিরাজের রাতে (অর্ধেক রাত ও ফজরের মাঝে) কিছুক্ষণের মধ্যে নবীজি ভ্রমণ করে ফিরে আসেন, যা মানুষের মধ্যে ক্ষুদ্র জ্ঞানে অসম্ভব ও অকল্পনীয় মনে হয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিরিখে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহর মিরাজ সত্যিই বাস্তব। মহাকাশে যাওয়ার আগে আল্লাহর সুনিপুণ ডাক্তার জিব্রাইল (আঃ) নবীজির বক্ষ বিদীর্ণ করে অন্তর থেকে জড়ধর্মী স্বভাব দূর করে শক্তিশালী আলোর স্বভাব স্থাপন করেছিলেন। কুদরতি ঔষধও তাঁর শরীরে প্রয়োগ করা হয় গ্যাসীয় বস্তুর মধ্যে টিকে থাকার জন্য। এ সফরে নবীজিকে স্বেচ্ছায় কিছুই করতে হয়নি। তিনি শুধু নির্দেশ পালন করেছিলেন মাত্র। যাঁর বিজ্ঞানময় কুরআন, পদার্থ বিজ্ঞান, মহাজাগতির বিজ্ঞান আলোক বিজ্ঞান, গতি ও সময়ের সর্বশেষ গবেষণালব্ধ ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে জানেন, তাঁদের কাছে মিরাজের সম্পূর্ণ বিষয়টি সত্যতা দিনের মতো উজ্জ্বল। চোখের পলকে লাখো-কোটি মাইল পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা আল্লাহপাক ‘বোরাক’কে দিয়েছেন। বোরাকের নিয়ন্ত্রণকারী স্বয়ং আল্লাহ, তাই চন্দ্র অভিযান অ্যাপোলো ১৬-এর মতো তা বিকল হওয়ার নয়। বোরাক আরবি ‘বারকুন’ শব্দ থেকে উদ্ভ‚ত। যার অর্থ হলো বিদ্যুৎ এটা নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন, আলোর গতিবেগ অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থাৎ এর গতি অকল্পনীয় দ্রæত। বিদ্যুৎ বা আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল। বোরাকের গতি এর চেয়েও দ্রুত হওয়ার কারণেই অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসূল (স.)-এর সপ্তকাশ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। আর ‘রফরফ’ হল ‘বোরাকের’ চেয়েও শক্তিশালী, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। ‘রফরফ-এর অভিধানিক অর্থ নরম, তুলতুলে, সবুজ, বিছানা। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতিবেগ।

নবীজির মিরাজ সশরীরে হয়েছিল বলেই ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’-এর মতো বাহন ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘বোরাক ও ‘রফরফ’ থিওসফি শাস্ত্রের ‘এথালিক দেহ’ মানস দেহ অপেক্ষা অধিকতর সূক্ষè, শক্তিশালী, প্রযুক্তিময়, যা স্থান কালের মাঝে কোনো সীমা পরিসীমা ছাড়াই সসীমে মিশে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বালোকে ছুটতে পারলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। এটাকে মুক্তিগতি বলে। নবীজির ‘বোরাক’-এর গতি আলো বা বিদ্যুতের চেয়ে বেশি ছিল বলেই তার পক্ষে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করা সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল। প্রকৃতির প্রকৃত সময় মানুষের জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীর ঘড়ি অন্য গ্রহে অচল। গতির তারতম্য সময়ের তারতম্য ঘটে।

আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘আলোর গতির যতই কাছে যাওয়া যায়, সময় ততই শ্লথ হয়ে আসে এবং আলোর গতি অপেক্ষা বেশি দ্রুত গতি হলে সময় উল্টো দিকে হয়।’ রাসূল-এর বাহনের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি ছিল বলেই অল্প সময়ের মধ্যে মিরাজের মতো এত বড় দীর্ঘ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল। স্থান, কাল, জগৎ সব কিছুই গতির ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহপাক অফুরন্ত শক্তি দিয়ে যে কোনো সময় যে কোনো অঞ্চলে স্থির সময়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারেন, যা ঘটেছিল নবীজির মিরাজের সময়। রাসূল (স.) মিরাজের রাতে বিস্ময়কর ভ্রমণ শেষে সেখান থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ শরিয়তের ১৯টি আহকাম প্রিয় উম্মতদের জন্য তোফাস্বরূপ নিয়ে এসেছেন (যা সূরা বনি ইসরাইলের ২২ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াতে এবং ৭৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে)। মিরাজের শিক্ষা মুমিন বা বিশ্বাসী হওয়ার শিক্ষা। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এ কথা প্রমাণ করে যে, রাসূল (স.)-এর মিরাজ হয়েছিল সশরীরে ও সজ্ঞানে, যা চিরসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট


poisha bazar