নারী ভাবনা ও পান্না ঘোষের বেঁকে যাওয়া কাঁধ


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:০৮

বিলকিস ঝর্ণা: বালু ঘড়ি শেল্ফের কর্নারে আরও পুরনো হয়। আমার নারী বোধে ধুলো জমে। নারীকথন বলবার সময় হয় না কোনো। নারী দিবসের দোরগোড়ায় পরিকল্পনার আসর। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের চমৎকার ইস্যু। নারীকে সম্মাননা -সংবর্ধনা -- নারী নিয়ে কতশত মহৎ ভাবনা। বিষয় ভাবনা আমাকে বরাবরই অবাক করে। সভ্যতার দিনক্ষণ বহু পুরনো। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের ভোটাধিকার সময় শুরু মাত্র কিছুদিনের। তারও অনেক দিন থেকে গেছি অবরোধবাসিনী।  ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। অসচেতনায়।

মধ্যযুগের ধর্মীয় কুসংস্কার ছাপিয়ে এযুগের দ্বিধাবিভক্ত নারীদের কিছু অংশেমাত্র মানুষের চেতনায় নিজেকে দেখে। পিছনের সারিতে আমরা সর্বদা হাততালি দিয়েই তুষ্ট। তবুও নারী নিয়ে যত ভাবনা-- যত চেতনা, উদারতা।

সব উগরে উঠে সভা সমিতি আর দিবসের রঙ্গমঞ্চে। আমি প্রথম গতবছর আমার কর্মক্ষেত্রে নারী দিবস উদযাপনের ঢলপ্রহরে ছিলাম। সবাইকে বেগুনি শাড়িতে দেখে, নারী দিবসে বেগুনি রঙের শাড়ির বিশেষত্ব জানবার ইচ্ছে হয়েছিল। নগর জনের নারী কথন। যেন মহাশূন্যে ভাসমান কিছু ধুলাবালি। সতর্কে পাশ কাঁটায়। মহাজনী প্রভুদের চোখ জ্বলে না। নইলে যে আমরাও ছাতা হারাই- আর সমাজ নামক ছাদও। শীতকালীন আরও একটু মূল্যবান ভেসলিন। তবুও বেশ। একটা নারী দিবস আছে।

আমরা তেলে তেলেই এগুতে থাকি। অন্তত নীতির প্রশ্নে ঘরছাড়া-বরছাড়া-অতঃপর দেশছাড়া না হই। সংবিধানে অনেক নীতি নির্ধারণের পাশে নারী অধিকার সংযোজিত আছে। অধিকার ঘরেও। বাসের সামনের কয়েকটা সিটেও। আর বহু পুরুষের ভিড়ে শরীর নামক এক প্রাকৃতিক অস্তিত্বে। আমার তব্ওু গলায় কথা আটকে যায়। মহিলা সিটে বসা পুরুষ লোকদের পিছনে গিয়ে বসতে বলতে। একদিন বলতে বলতে ক্লান্ত হলাম। ডাবল সিটের একটা খালি। আরেক টায় আমি। একেকজন বাসে উঠেই বিরক্ত হয়ে সরে বসতে বলে। বিরক্ত এজন্য যে তাদের উঠতে দেখেও কেন নিজ থেকেই সরে গিয়ে বসতে দিলাম না। পিছনে অনেক জায়গা আছে। আমি পিছনে বসতে বললাম। তর্কে যেতে হলো। বললাম- পিছনে জায়গা না থাকলে তবে এখানে বসবেন। একসময় একটা মেয়ে উঠে একটা মহিলার পাশে তার জন্য জায়গা পেয়ে গেছে দেখে স্বস্তিতে বসে পড়লো। আমিও হাপছেড়ে বাঁচলাম।

মধ্যাহ্নে কর্পূরের গন্ধ। তবুও বিষাক্ত ভয় শীতের ঋতুতে। লেপ - কম্বল জুড়ে ব্যস্ত ঘামের রোদ পোহানোর তাড়া। মানুষের মেলায় ভিড়। গৃহকোণে হিজাবের ফিটনেস। নারীকে কি সাহস যোগায়! সাহস যোগায় নারীর অভিভাবককে। পুরুষ অভিভাবককে!

সহকর্মীর ফেসবুকে পারিবারিক ছবি। স্ত্রীর মুখে কার্টুন সেটাপ। আহত হয়ে কমেন্ট করে বসি।

‘ভাই আপনার মুখটা খোলা পাশের জনের মুখে কার্টুনে ঢাকা?’ পুরুষতন্ত্রে অহংকারী, নারী সম্পর্কে কটুকথায় পারদর্শী আমার সহকর্মী রিপ্লাই দেয়- ‘খোলা তরমুজের দাম নেই।’

আমি উলু বনে মুক্তা ছড়াই না আর। পিছু হটি। এমনি আরও কত পিছনে হটার গল্প জমে রোজ। গল্প জমে নারী হয়ে ওঠার। শরীরে নয় চেতনায়। জাগিয়ে দেয় মানুষের অধিকারে সোচ্চার হতে। নাড়িয়ে দেয় আরও অনেকখানি। আমি মুক্তির পথে আগাই। পাঠ্য বইয়ের পাতায় তখনও নারী বিশেষণ অমূলক। আমার ঠিক ভুলের সমুদ্রে তখন সকল নিরামিষ মৎসজীবী।

নারী সংস্কার মুক্ত নারীর পাশে দাঁড়াই না আর। বিপ্লবের মাঠে চেয়ারের লড়াই। মঞ্চের পর্দায় রোজ এঁকে দেই কিছু দৈন্য নির্যাস। মানুষ মুছে দিতে থাকে রোজ নিপুণ হাতে। মানুষের যাপন আর হয় না তাই। নারী হয়ে বেঁচে রই অন্য নারী-পুরুষের সামাজিকতায়। তবু নারী যাপনেই স্বাচ্ছন্দ্য। মাথার ওপর ঝুলিয়ে রাখি পুরুষতন্ত্রের ছাদ। বনেদি আনার খোলস থেকে যখন অনেকটা বাইরে। চারপাশে যখন ঘন অন্ধকার। তখন খোলসের ভেতর আর বাহিরের কি তফাৎ। নারীকে কোন মুক্তির পথের কথা জানাতে চায় মানুষ? বাইরে আসার নাকি বাহির থেকে ভেতরে যাবার?

দুই বিপরীতমুখী মুক্তির দরজায় সেঁটে গেছি আমরা। পৃথিবীর একপেশে ইতিহাসে মুখ থুবড়ে পরে থাকে নারী কথন। চাপিয়ে দেয়া কতৃত্ব, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়ে সমাজ সভ্যতাকে চলমান রাখার গুরুদায়িত্ব বয়ে চলেছে নারী। নারীর রন্ধ্রে গেঁথে যাওয়া পুরুষতান্ত্রিক অন্যায়ের পক্ষে তাই নারীদেরই কটাক্ষ যুক্তি নারী জাগরণের চেতনার গলা চেপে ধরে। আর নারীই তখন হয়ে উঠে নারীর নিপীড়ক। উগ্রতা পরিহার করে আত্মত্যাগের বিনিময়ে শান্তি বজায় রাখাই নারীর আত্মতৃপ্তি। সভ্যতার ক্রমবিকাশে তাই পুরুষতন্ত্রের উত্থান পেতে থাকে প্রতিনিয়ত। বিভক্ত চেতনায় নারীবাদ পুরুষবাদেরই সমার্থক। মানুষতন্ত্র তাই মথিত আর ব্যথিত। নারীর অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

আমার বন্ধুসম এক নারীর সঙ্গে লোকাল বাসে উঠেছিলাম। আমার প্রতিদিন লোকাল বাসে ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে যাওয়া আসা কর্ম ক্ষেত্রে। আমি তখন হাই স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক। তিনি বলেন, এরকম লোকাল বাসে যাতায়াত করে তাকে কোনদিন চাকরি করতে দেবে না। আমি লজ্জা পাবো না দুঃখ পাবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার কালোবাজারি মামার সুন্দরী বি কম পাস স্ত্রী বলেন, মামা তাকে বলেছেন, ‘স্কুলে চাকরি করে তুমি কতটাকা পাবে। তার দশ গুণ তোমাকে মাসে হাত খরচ দিবো।’ এরকমভাবে আমি অসংখ্য দিন ছোট নারীর চোখে আমাকে ছোট করতে দেখেছি। স্বামীদের টাকায় তাদের উন্নত গ্রীবা। কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই প্রভাতেই বদলে ফেলেছিলাম কবিতার সমঝোতা।

দই ওয়ালা দই হাঁকে না- বই ওয়ালা বই-। জীবন এখানে অন্য কথা বলে। এরা বেগুনি শাড়ি আর ম্যাচিং হিযাব পরে সম্মাননা নেয়। ফেরিওয়ালার কাঁধে বড় নির্মম সময়ের কুঁজো। পান্না ঘোষের বেঁকে যাওয়া কাঁধ বয়ে চলে- চকচকে রসালো পানতোয়া। আমি সমীকরণ মেলাতে ওপাশের হাঁড়িতে রাখি জমে যাওয়া দই। অতঃপর পান্না ঘোষের এটাই জীবন। সেখানে কোনও তেপান্তর নেই। আর মজা পুকুরও। আছে এক জলজ্যান্ত নারী। প্রজাপতি ধ্যানে আমি আজও পুরাতাত্তি্বক মুদ্রার প্রতিশব্দ খুঁজি। খুঁজে চলি অন্য এক মানুষ। মানুষের ভেতর। জীবনের মানে তার ভিন্ন। হুবহু মানুষের মতো।


poisha bazar