'সীমান্তে ফেলানী হত্যা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি'


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩২

কে এম আবু তাহের:: সীমান্তে ফেলানী হত্যা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা ফেলানী খাতুন (১৬) নামের এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে।

ফেলানীর বাবা নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম নূরু ১০ বছর ধরে নতুন দিল্লিতে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সেখানেই থাকতো ফেলানী। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় বাবার সঙ্গে ফেরার পথে, সীমান্তে কাটাতারের বেড়া মই বেয়ে পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর। এতে ভয়ে সে চিৎকার দিলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ কাটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে।

ঘটনাটা খুবই অমানবিক কারণ একটা কিশোরী মেয়ে ভয়ে-আতঙ্কে যখন চিৎকার করে উঠলো তখন যে কোনও মানুষেরই কর্তব্য তাকে সাহায্য করা কিন্তু ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তার উল্টো কাজ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। ঘটনাটি ছিল খুবই অমানবিক।

কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ফেলানিতো একটা উদাহরণ আমরা ১৯৭২ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত পর্যালোচনা করে দেখতে পাই যে, এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রায় ২ হাজার নিরস্র ও নিরীহ বাংলাদেশী মানুষ নিহত হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার বড় একটি কারণ গরু চোরাচালান। ভারতে গরুর যথেষ্ট কদর রয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতায় এসে গরু সুরক্ষা ও পাচার বন্ধে অত্যন্ত কঠোর হয়। ২০১৫ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে। এরপর গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু চোরাচালান ব্যাপক হারে কমে গেছে। ভারত থেকে শুধু যে গরু চোরাচালান হয় তা নয়, ফেনসিডিল, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রও আসে। কিন্তু এসব চোরাচালানে সহিংসতার ঘটনা কম ঘটে। বিএসএফের চোখে পড়ে সীমান্তে পার হওয়া গরু। কিন্তু এই গরুগুলো সীমান্তের খুব কাছ থেকে যে আসে তা-ও নয়।

ভারতের কতগুলো জেলা, প্রদেশ ও থানার উপর দিয়ে গরুগুলো আসে। গরুগুলো যে সীমান্তে পাচার হচ্ছে, সেগুলো যাতে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত না আসতে পারে, সে ব্যবস্থা রাজ্য সরকারগুলো নিতে পারে। কিন্তু তা নেয় না। তাতে অবৈধ লেনদেন ও ভাগ-বাটোয়ারা বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএসএফও অনেকাংশে দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে চোরকারবারির কাছে পয়সা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

বিএসএফ অ্যাক্ট-১৯৬৮ অনুযায়ী গরু চোরাচালান সন্দেহে বিএসএফ সন্দেহভাজনের বুকে গুলি চালাতে পারে না। এমনকি ভারতীয় আইনে গরু পাচারকারী, চোরাচালানকারী কাউকে হত্যা করা তো দূরের কথা, একটা চড় মারারও এখতিয়ার নেই। কিন্তু দেশটির শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা ও বিএসএফের কার্যকলাপে এ আইনের কোনোই প্রতিফলন নেই।

২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ফাঁড়িতে বিএসএফ সদস্যদের উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, ‘আমি চাচ্ছি, গবাদি পশু পাচারের বিরুদ্ধে বিএসএফ এমন ধরপাকড় শুরু করবে যে বাংলাদেশিরা গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেবে।’

তার ওই বক্তব্যের পর সীমান্তে অপরাধীদের ধরতে বিএসএফকে আরও সহিংস হয়ে উঠে। বাংলাদেশ-ভারতের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক চিরন্তন। সরকারিভাবে দুইদেশ একে অপরকে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র বললেও সীমান্তে হত্যা বন্ধের কোনও ল²ণ দেখা যাচ্ছে না।

দুদেশের সরকারের মধ্যে বৈঠক হয়, আলোচনা হয়, অঙ্গীকার হয় তবুও থামে না এ হত্যা। সব কিছুই এখন লোক দেখানো ও রাজনৈতিক।

এইচআরডব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। এমন ব্যক্তিদের মোকাবিলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্বপ্রণোদিত হয়ে, আইনের তোয়াক্কা না করে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছিল। এইচআরডব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, তদন্ত করা মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে, হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে; যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।

সুতরাং, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। তাই ফেলানী হত্যা দিবসে আমাদের দাবি বাংলাদেশের নতজানু সরকারকে বাংলাদেশীদের স্বার্থে আরও জোরালো প্রতিবাদী হতে হবে। আজকের পর প্রতিটি সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতীয় হাই কমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে প্রতিবাদ জানাতে হবে-প্রতিটি সীমান্ত হত্যার সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট/দোষী সাব্যস্ত বিএসএফ জোয়ানের শাস্তি দিতে হবে।

লেখক: সভাপতি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)


poisha bazar