

মো হাবিবুর রহমান: বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে জ্বালানি তেলের আধিপত্য সর্বজন স্বীকৃত। বৈশ্বিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন দেশের শিল্প, অবকাঠামো ও কৃষিতে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠার পেছনে জ্বালানি তেলের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের বিকল্প ব্যবস্থা থাকলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে না বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে। তাই এই বহুল কাক্সিক্ষত জ্বালানি তেলের জাদুকরী স্পর্শে অনেক দেশের দুর্বল অর্থনীতিও রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। অনেক দরিদ্র দেশ তেল বিক্রি করে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধশালী হয়েছে। সেসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানেরও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সেই সাথে উনিশ শতক থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তেল ‘কী-ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে আসছে।
হাজার হাজার বছর আগে থেকেই পৃথিবীতে জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়ে আসলেও ১৮৪৬ সালে আজারবাইজানে ফায়দোর সিমিয়োনত নামের প্রযুক্তিবিদ প্রথম কুপ থেকে তেল উত্তোলন করেন। ১৮৫৯ সালে আরও গভীর কুপ খননের মাধ্যমে কর্নেল ডেক যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত তেল উত্তোলন করেন। কিন্তু এর মজুদ দীর্ঘদিন স্থায়ী ছিল না। তেলের ওপর ভর করেই আধুনিক অর্থনীতির ভিত গড়ে উঠায় জ্বালানির জন্য বিশ্বের তৃষ্ণা বেড়েই চলছিল এবং তেলের অনুসন্ধানে ব্যাপক কুপ খনন কাজ শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে পারস্য অঞ্চলে সর্বপ্রথম তেলের খনি আবিষ্কার এবং ১৯৩৮ সালে প্রথম তেলের সন্ধান পাওয়া যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে অধিক পরিমাণে তেলের খনি থাকলেও তা উত্তলনের ভার সেভেন সিস্টার্স খ্যাত পশ্চিমা ৭ টি তেল কোম্পানির হাতে ন্যস্ত ছিল। যার দরুন বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে দৃশ্যমান উপস্থিতি ও গতি আসেনি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এবং বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ করার দায়িত্ব মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে নিয়ে আসতে ১৯৬০ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ১৩ টি দেশের সমন্বয়ে ওপেক গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে ওপেকভুক্ত রাষ্ট্রগুলো কতক ধনী রাষ্ট্রের কাছে তেল বিক্রিতে অসঙ্গতি জানালে তেলের দাম প্রতি লিটারে ৩ ডলার থেকে বেড়ে ১২ ডলারে উঠে যায়। যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে তেলের প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়। তেলের দামকে কেন্দ্র করে ১৯৭৮, ১৯৯০ ও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দাবস্থার তৈরি হয়। এমনকি ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার পেছনে তেলের অবদান আছে বলে মনে করা হয়।
বর্তমানে বিশ্বের শক্তির উৎসের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি জ্বালানি তেলের দখলে থাকা এবং অর্থনীতিতে তেলের উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট তেলের বিশৃঙ্খল সরবরাহ ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও একবার মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কয়েকমাস আগেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলারে বিক্রি হলেও এখন তা কমে ৯০ ডলারে নেমেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ তেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকায় বাড়তি দামে চাপ সামাল দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছিল আমদানিকারক দেশগুলো। যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দামে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করায় সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির পারদ ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে গিয়েছিলো।
তবে বিশ্বঅর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কায় ধীরে ধীরে কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। বিপিসির সূত্র অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৭০ লক্ষ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ দেশীয়ভাবে পেট্রোলের যোগান দিতে সমর্থ হলেও অকটেনের একটি বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত জ্বালানি ক্রয় ও সরবরাহ বাবদ ৮০১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি ডলারের দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ভর্তুকি বন্ধ ও পাচার রোধে গতমাসে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম অসঙ্গতিপূর্ণভাবে বাড়িয়েছে সরকার। অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের প্রভাব থাকায় তেলের বাড়তি দামে প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে। আয়ের সাথে ব্যায়ের বিস্তর ফারাক তৈরি হওয়ায় অসহনীয় অস্বস্তিতে পড়েছে মানুষ।
তবে গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আসলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমানোর কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকার গত ০৬ আগস্ট ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা এবং পেট্রলে ৪৪ টাকা বাড়িয়েছে। একবারে জ্বালানি তেলের দাম নজিরবিহীন এমন বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে যেমন সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে পরিবহন খরচও। এভাবে দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যা দিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছিলো যে ২০২১ সালের ০৩ নভেম্বর স্থানীয় পর্যায়ে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধি করে পুনর্র্নির্ধারণ (ডিজেল ৮০ টাকা ও কেরোসিন ৮০ টাকা) করা হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা সত্ত্বেও অকটেন ও পেট্রলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। এর আগে ২০১৬ সালে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করেছিলো। অর্থাৎ এর পর দীর্ঘদিন আর আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওঠানামার সাথে সমন্বয় করা হয়নি। এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয়ও অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ প্রকল্পের (কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প) উপ-প্রকল্প পরিচালক (অ্যাপ্রোচ রোড, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ ও এনভায়রনমেন্ট) মো. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আমাদের প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব প্রকল্পে আছে। অনেক ইক্যুইপমেন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ৫শ কোটি টাকা লাগবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, এসব মালামাল সমুদ্রপথে চীন থেকে দেশে আসবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া বাড়তি ভাড়া দিয়েও মিলছে না শিপমেন্ট। প্রকল্পের অনেক যন্ত্রাংশ দেশেও পরিচালনা করা হয় ডিজেলে। ডলারের দাম বাড়ায় রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়তি। এসব নির্মাণসামগ্রী চলমান প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। যা সমাজের নি¤œ মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের ধারাবাহিক জীবন যাত্রার মানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক জ্বালানি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিমন্ত্রী জেনফোর গ্রানহোম বলেন, ‘জ্বালানি খাতের বিশৃঙ্খলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর গুরুত্ব আবারো স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিশুদ্ধ জ্বালানির জন্য আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপ হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা।’ আন্তর্জাতিক জ্বালানির সংস্থার মতে জ্বালানি তেলের কারণে সৃষ্ট বর্তমান সংকট আরো ঘনীভ‚ত হবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে পূর্বের চেয়ে আরও বেশি অস্থিতিশীল করে তুলবে। তাই বিশ্বকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে সূর্যালোক, পানি ও বায়ুর মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। হাইড্রোজেন জ্বালানি (নবায়নযোগ্য সবুজ ও পরিবেশবান্ধব) উৎপাদন বিশ্বকে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানি কেন্দ্রিক বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা রোধে সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়ন বাড়াতে হবে।
সময়ের সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ কমে যাওয়া, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও অর্থনীতি অস্থিতিশীলতার চাবিকাঠি গুটিকয়েক দেশের হাতে থাকায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা এখন সময়ের দাবি। জ্বালানি তেলের মজুদ ফুরিয়ে আসায় ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিশ্বকে বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থার দিকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। এর পাশাপাশি পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশ ও সমাজের মানুষকে সাশ্রয়ী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে একত্রে কাজ করতে হবে। এর জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে, যেমন- ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস-আদালতে কিংবা বাসায় এসি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামানো যাবে না। আলোকসজ্জা আপাতত বন্ধ করতে হবে। বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে শেষ করতে হবে। বাজার, মসজিদ, শপিংমলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে এবং ৮টার মধ্যে তা বন্ধ করে দিতে হবে। মূলকথা হচ্ছে, এই সংকট উত্তরণে আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি প্রত্যেক নাগরিক সচেতন আচরণ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই এ সংকট থেকে উত্তরণ লাভ সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
মানবকণ্ঠ/এআই