

জয়দেব রায়: প্রতি বছর মহান শিক্ষা দিবস আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু এই দিনটি কি এবং কেন তা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি আমরা। এই দিনটি বাঙালির অধিকার আদায়ের দিন, স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালির শিক্ষার অধিকার আদায়ের দিন সেটা কি আমাদের কোনো কাজে-কর্মে, শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে? এটা এখন বড় একটি প্রশ্নাকারে দেখা দিয়েছে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এস এম শরীফের নেতৃত্বে এই শিক্ষা কমিশন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা ছিল বাঙালির শিক্ষা প্রসারের বিপক্ষে। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ শিক্ষা কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, পাঠ্যপুস্তক, বর্ণমালা নিয়ে সমস্যা, অর্থ বরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংক্রান্ত নানা বিষয় উপস্থাপন করা হয়।
এই কমিশন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থায় নানান জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকালাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। রিপোর্টে বর্ণমালা সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখে। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাই শিক্ষার অংশ, যা শরীফ শিক্ষা কমিশনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র ইউনিয়ন আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে তীব্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৬২ সালে ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার বিরোধী এ কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন চ‚ড়ান্তভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। অবশেষে ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।
ওই দিন সকাল দশটায় হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে উপস্থিত হয়। কিন্তু তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে গুলি বর্ষণ হয়েছে এমন গুজবে সমবেত জনতা মিছিল নিয়ে নবাবপুরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। হাইকোর্টের সামনে যখন জনতা উপস্থিত হলো তখন পুলিশ বাধা দিলেও মিছিলকারীরা কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা না করে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হলে পুলিশ লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। ১৯৬২ সালের ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলনে নিহত হন ওয়াজিউল্লাহ, মোস্তফা, বাবুল, সুন্দর আলীসহ নাম না জানা অনেকে। শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুপ্রেরণা দেয়। বলতে গেলে শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে বেশ কিছু শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষানীতিকে হাজির করা হয়েছে নতুন নতুন মোড়কে। এই শিক্ষানীতিগুলোতে সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক যে শিক্ষা সেগুলো বরাবরই উপেক্ষা করা হয়েছে। সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রগতিশীল লেখকদের লেখনি। বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে আনা হয় আমুল পরিবর্তন। হুমায়ুন আজাদের “বই” কবিতা তুলে দেওয়া, কুসুমকুমারী দাশের “আদর্শ ছেলে” কবিতার বিকৃতিসহ আরো নানান পরিবর্তন এনসিটিবিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলা বইতে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা জানবো সুকান্তকে, বঙ্কিমকে, জানবো হাসান আজিজুল হক, জানবো বিদ্যাসাগর, ড.নীলিমা ইব্রাহিম, সুফিয়া কামাল, তারাশংকর, রোকেয়া, হুমায়ুন আজাদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মানিক, শরৎচন্দ্র, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ আরো নানান সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম। আর ধর্মীয় বইতে জানবো ধর্ম, ধর্মগুরু, ধর্মীয় নৈতিকতা। সুতরাং এনসিটিবির উচিত এ বিষয়টি নজরদারিতে আনা। শিক্ষা যদি পণ্য হয় তাহলে ১৯৬২র শিক্ষা আন্দোলনকে উপেক্ষা করা হয়। যেটা একদম অনুচিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকল ধরনের শিক্ষার্থীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ উচ্চহারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে অনেক শিক্ষার্থী অকালে ঝরে পড়ছে। শরীফ শিক্ষা কমিশনে যেমনটা বলা হয়েছিল ‘অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা, বস্তুত অবাস্তব কল্পনামাত্র’ সেটার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটছে এখন। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার পরে আমরা দেখতে পাই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার পরেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারছে না। ব্যাপারটা অনেকটা টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার চরিত্র হারিয়ে দিনদিন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হলে সিটের সংখ্যা অপর্যাপ্ত হওয়ায় এসমস্ত শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হয় প্রথমে। গণরুমে পড়াশোনার পরিবেশ নেই বললেই চলে। গণরুমগুলোতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এতে করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। একটি তিক্ত সত্য কথা না বললেই নয়। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় তখন মেধাবীদের বাদ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয় লোকজনদের। এতে করে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অসংখ্য লোকজন বসবাস করছে। পাঠ্যপুস্তকে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনের প্রতিচ্ছবি তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না। এসব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য রয়েছে।
এসব দিকে খেয়াল রেখে এসব জনগোষ্ঠী থেকে আগত শিক্ষিতদের মধ্যে থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাসম্ভব নিয়োগ দিতে হবে। স্বাধীনতার পরে অনেক শিক্ষা কমিশন অনেক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করেছে। শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতিতে আমাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার পরে যে শিক্ষা কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে সেগুলো কোনোটাই পূর্ণভাবে আমাদের আশা আকাক্সক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থার এই সংকটে কিছু দাবিনামা উপস্থাপন করছি। সকল শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, ইউনিফর্ম, নাস্তা বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। সকলের জন্য উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের ২০ শতাংশ রাখতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে একটা কথা বলবো, শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা সুযোগও নয় বরং শিক্ষা আমাদের অধিকার। আর সেই অধিকার কে পুরোপুরি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। শিক্ষার মধ্য দিয়ে যদি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির, বিজ্ঞানের বিকাশই না ঘটে তাহলে সেই শিক্ষার কোনো অর্থ নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
মানবকণ্ঠ/এআই