
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং লেবু-কমলেশ হত্যা
- ১১ মার্চ ২০২৩, ১৭:০৬

ম. মানিক: সম্ভবত ১৯৮৭। শীতের মৌসুম। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী সংগ্রামে সারা দেশ উত্তাল প্রতিবাদমুখর। আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশের প্রতিটি জেলায় সাংগঠনিক সফরের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। দেশের সবগুলো জেলাকে কয়েকটি সাংগঠনিক টিমের আওতায় নিয়ে আসি।
বিভিন্ন জেলা সফর শেষে কোনো এক শিশিরভেজা ভোরে আমাদের সাংগঠনিক টিমের যাত্রা গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার উদ্দেশ্যে। এ দুটি জেলার প্রধান কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সেমিনার আলোচনা সভাসহ নানাবিধ স্বৈরাচারবিরোধী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সাংগঠনিক টিমের সাংগঠনিক কর্মসূচির সমাপ্তি টানি। গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলা সফরের প্রথম দিনের কর্মসূচি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামদিয়া সরকারি এস কে কলেজ। আমরা কাশিয়ানী সরকারি এস,কে কলেজের নির্ধারিত কর্মসূচির আগের দিন বিকালে গোপালগঞ্জে পৌঁছি। আমাদের প্রথম দিনের ঠিকানা আমাদের সফর সঙ্গী কোটালীপাড়া উপজেলার ইস্কান্দার আলী ফকিরের নিজ বাড়ি। ইস্কান্দার আমাদের নারায়ণগঞ্জ জেলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তুখোর ছাত্রনেতা এবং তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির এক সাহসী যোদ্ধা, সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিশাল এক শক্তি হয়ে ওঠা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জেলার সর্বত্র সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত। আমাদের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের গোপালগঞ্জ আসার খবর জানিয়ে ইস্কান্দার আগেই তার নিজ এলাকার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতায় কোটালীপাড়ার স্থানীয় একটি মাঠে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে রেখেছিলেন। আমরা সেই সমাবেশে স্বৈরাচারবিরোধী বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে আমাদের কর্মসূচির যাত্রা শুরু করি।
কোটালীপাড়ায় পা দিয়েই আমার বুকের ভেতরে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সুপ্ত আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আমার চোখের তারায় ভাসতে থাকে সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমিতে বুর্জোয়া আওয়ামী শাসক গোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর নির্মমতার নিষ্ঠুর শিকার গোপালগঞ্জের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট জননেতা শহীদ কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবু, জননেতা কমরেড কমলেশ দেবজ্ঞ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কমরেড বিষ্ণুপদ কর্মকার, কমরেড রামপ্রসাদ চক্রবর্তী মানিক।
গোপালগঞ্জের খুনি হেমায়েত চক্র তার নিয়োজিত লোকজনদের নিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই চার জনপ্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যার ইতিহাস আমি শুনেছি। আজ গোপালগঞ্জের বিভিন্ন মানুষের সাথে আলাপ চারিতায় তাদের হত্যার নির্মম ঘটনার বর্ণনায় আমি শিহরে উঠি।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে কমলেশ বেদজ্ঞ পরাজিত হন। নির্বাচনী রেজাল্ট শেষে তারা গোপালগঞ্জে ফিরে আসবেন। এর আগে ৯ মার্চ কোটালীপাড়ায় একটি কর্মিসভা করে তারা রাত্রিযাপন করেন কমরেড বামন ধরের বাড়িতে। পরদিন সকাল ৭টায় কমরেড লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ, বিষ্ণুপদ, মানিক, লুৎফর রহমান গঞ্জর প্রমুখ একত্রে সিকির বাজার থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে হেঁটে রওনা হলেন। হাঁটতে হাঁটতে তারা টুপুরিয়া গ্রামে পৌঁছলে হেমায়েত এর নেতৃত্বে সশস্ত্র মোজাম সর্দারের ছেলে মোহনসহ বিশাল একটি দল তাদের পথরোধ করে এবং কমলেশ বেদজ্ঞকে ডায়েরিটি ফেরত দিতে বলে। যে ডায়েরিটিতে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী খুনি হেমায়েতের অপকর্ম ও মুক্তিযুদ্ধে পকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প দখল করে দখলকৃত সম্পত্তির তালিকা ছিল। তারা ডায়েরিটি দিতে অস্বীকার করলে খুনিরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত করে ভয়ানক জখম অবস্থায় তাদেরকে একটা নৌকায় উঠিয়ে মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকাটা ডুবিয়ে দেয়। এ সময় সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক এবং বিষ্ণুপদ নিহত হন। মৃত অবস্থায় লুৎফর রহমান গঞ্জর খালের পাড়ে পড়ে থাকে। কমরে ওয়ালিউর রহমান লেবু পার্শ্ববর্তী হাবিবুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বাড়িটি ঘেরাও করে হেমায়েত বাহিনী আগুন ধরিয়ে দিতে গেলে কমরেড লেবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। খুনিরা জনগণের প্রিয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের প্রধান সমন্বয়ক কমিউনিস্ট নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবুকে নির্মমভাবে তিনমাইল পর্যন্ত পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কমরেড লেবুকে হত্যা করে তারা। এই নির্মম পাশবিক হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয় প্রকাশ্যে এবং উপস্থিত গ্রামবাসীর সামনে।
১৯৭৩ সালের ১১ মার্চ, দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে সেদিনের গণহত্যার খবর প্রকাশ হয়েছিলো এভাবে ---
ফরিদপুরের পল্লীতে ৪ ব্যক্তিতে পিটাইয়া হত্যা
বার্তা সংস্থা 'এনা' পরিবেশিত এক সংবাদে প্রকাশ, গতকাল (শনিবার) ফরিদপুর জেলায় গোপালগঞ্জ মহকুমাধীন টুপুরিয়া গ্রামে উচ্ছৃঙ্খল জনতা বেআইনি অস্ত্র বহনের অভিযোগে ৪ ব্যক্তিকে পিটাইয়া মারিয়া ফেলিয়াছে ও অপর জনকে মারাত্বকভাবে আহত করিয়াছে।
ফরিদপুর পুলিশ বার্তা সংস্থাকে জানান যে, আহতদের মধ্যে একজন হইতেছেন গত ৭ মার্চের নির্বাচনে ফরিদপুর-১২ নির্বাচনী এলাকা হইতে ন্যাপ প্রার্থী শ্রী কমলেশ চন্দ্র বেদজ্ঞ।
তিনি বলেন যে, অপর একজন উক্ত এলাকার নেতৃস্থানীয় কমিউনিষ্ট কর্মী জনাব ওয়ালিউর রহমান (লেবু) বলিয়া জানা গিয়াছে। অভিযুক্ত খুনি হেমায়েতউদ্দিন।
একই দিনে দৈনিক সংবাদের রিপোর্টে বলা হয়, জাতীয় সংসদ ২১২ ও ফরিদপুর-১২ আসনে প্রতিদ্বন্দিতায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর) ন্যাপ এর প্রার্থী কমলেশ বেদজ্ঞ, বাংলাদেশর কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট্য নেতা কমরেড ওয়ালিওর রহমান লেবু, ছাত্র কর্মী শ্রী শ্যামল ব্যানার্জী ও মানিককে গতকাল (শনিবার) সকালে কোটালীপাড়া থানায় টুপুরিয়া গ্রামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিহতদের মধ্যে বিষ্ণুপদ নামে অপর এক ব্যক্তির নাম উলেখ করেন। ঘটনায় আহত ছাত্র কর্মী লুৎফর রহমান গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে মহকুমা প্রকাশক জানিয়েছেন।
হত্যাকারীরা তাহাদের পিটাইয়া হত্যা করার পর দুইটি পিস্তল জমা দিয়া অভিযোগ করে যে, উক্ত কমলেশ বেদজ্ঞ এবং অন্যরা অস্ত্র লইয়া যাইতেছিল। আমাদের কাছে সুস্পষ্ট খবর, নির্বাচন শেষে অদ্য তাহারা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় স্বাভাবিক কাজে গোপালগঞ্জ যাইতেছিল। হত্যাকারীরা পূর্বাহ্নে খবর পাইয়া পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এখানে ডাক্তাররা দেখতে পান লুৎফর রহমান গঞ্জর তখনো জীবিত। তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হত্যাকাণ্ডের নৃশংস বিবরণ দেন। এই জবানবন্দিটি পরবর্তীতে থানায় এফআরআই (মামলা) হিসাবে গণ্য করা হয়।
ওই ঘটনার পরদিন ১১ মার্চ লুৎফর রহমান গঞ্জর জবানবন্দি অনুযায়ী গোপালগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয় (মামলা নং-০৫, তাং-১১-০৩-৭৩, জিআর নং-৯৬/৭৩)। মামলায় মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনী প্রধান হেমায়েত উদ্দিনসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। গোপালগঞ্জবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশ হেমায়েতকে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানল থেকে বাঁচাতে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কমরেড মনি সিংহের সঙ্গে কমরেড লেবুর অনুজ মোহাম্মদ আতাউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু কান্নার সুরে বলেন, 'আমি জানতাম না ওরা লেবুকে মেরে ফেলবে।'
এরপরও বিচারের জন্য আমাদের সাহসী ও আন্তরিক হতে হবে। পরিকল্পিত প্রচেষ্টা নিতে হবে। নয়তো শাসক শোষকদের প্রচলিত আইনে কোনো হত্যাকাণ্ডেরই বিচার সম্ভব হবে না।
প্রচলিত আইনে তাদের বিচারের আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি শহীদ বিপ্লবীদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করার লড়াই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করাই আজ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রধান করণীয়।
ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু বুর্জোয়া সমাজ, তাদের শাসন শোষণের কোনো পরিবর্তন হয় না। ইতিহাস নির্ধারিত এ এক নিষ্ঠুর সমাজ। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় চার জনপ্রিয় কমিউনিস্ট বাম প্রগতিশীল নেতাকে হত্যা নিধন নিষ্পেষণের এক নিষ্ঠুর অন্ধকার ইতিহাস। এবার এর পরিসমাপ্তি হওয়া দরকার
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কথাসাহিত্যিক