
নারীর ক্ষমতায়ন ও একজন শেখ হাসিনা
- ১০ মার্চ ২০২৩, ১১:৪৯

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার: আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ। দিনটির তাৎপর্য অনেক। প্রতি বছর এক একটি প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন হয় দিনটি। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’।
নারীকে কেবল নারী না ভেবে মানুষ ভাবার তাগিদ দিয়ে গেছেন মনিষীরা। উর্বশী কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী
রূপসী, হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!
নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে বহু কাব্য ও লেখনী ছিল কাজী নজরুল ইসলামের। কারও করুণার দিকে না তাকিয়ে নারীদের নিজেদের সক্ষমতার জাগরণ তৈরি করতে গিয়ে কারো কারো কাছে তিনি নারীবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। জাগো নারী, জাগো বহ্নি শিখা/ জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত টিকা, জাগো হতভাগিনী ধর্সিতা নাগিনী/ বিশ্বদাহন তেজে জাগো দাহিকা। ধূ ধূ জ্বলে ওঠে ধূমায়িত অগ্নি/ জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নি... ওই সময়ে এ ধরনের লেখা যেনতেন সাহসের কাজ নয়।
কথায় নয়, কাজে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারীর উন্নতি, মর্যাদা, ক্ষমতায়ন বিষয়ে বরাবরই সচেতন- আগুয়ানও তিনি। কেবল রাজনীতিতে নয়- ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরিসহ সবক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নে তার পদক্ষেপগুলো জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী করে তুলেছে তাকে।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরের এক অনুষ্ঠানেও শেখ হাসিনা নানা ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য উল্লেখ করেছেন। তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকটের কার্যকর সমাধান খুঁজতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদটি বিশ্বে আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে। নারী নেতৃত্বকে আরও এগিয়ে নিতে কিছু প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন দেশে এগুলো কম-বেশি কার্যকরও হচ্ছে।
প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী বা পুরুষ কারো উন্নতিই সম্ভব নয়। সেই বিবেচনায় নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যটিও চমৎকার এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী–পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তিতে নারীর সুযোগ বাড়ানোর বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে নারী–পুরুষের নানা অসমতার মধ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। সহজভাবে প্রযুক্তির ভাষা সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের একদম প্রান্তে থাকা একজন মেয়েকেও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব।
প্রযুক্তি নারীকে আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। বাইরে কাজ করতে গিয়ে পরিবারের বাধার মুখে পড়েন, এমন নারীরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। অতীতের ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান এবং বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে আগামীর কথা ভাবলে নারীর ক্ষমতায়নের আরো নানাদিক সামনে চলে আসবে।
একসময় ধারণা করা হতো, প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা এলিট সমাজের মানুষ। এ ধারণা ভেঙে গেছে। গত দু–তিন বছরে, বিশেষ করে করোনার সময় আমরা সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছি প্রযুক্তির আশীর্বাদ। প্রযুক্তির কল্যাণেই এ সময় ঘরে থাকলেও কোনো কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি। পেশাদারেরা নিজেদের কাজ করেছেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। অনেক নারী বাড়িতে থেকে বাড়ির সব কাজ প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে করেছেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ঔজ্জ্বল্য ছড়ানোর কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো উপলক্ষ ছাড়াও বলে আসছেন। নারী নেতৃত্বকে আরও এগিয়ে নিতে স্থানিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে তার প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসিত। বিশে করে নারীর ক্ষমতায়ন, তাদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তার আগে কেউ এভাবে সামনে আনতে পারেননি। নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ২৭-২৮ শতাংশ বরাদ্দের কথাও স্মরণ করতে হয়। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সর্বত্র নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সামনের সারিতে আনার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তিনি। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতমুক্ত ঋণ দিচ্ছে। এ ছাড়া পুনরর্থায়ণ প্রকল্পের ১৫ শতাংশ তহবিল, ১০ শতাংশ শিল্প প্লট এবং ১০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তহবিল নারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্জনগুলো ধরে রাখার প্রশ্নে নারীদের দায়িত্ব অনেক।
প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। গত ( ২০২১ সালের মার্চ) একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে তখন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী ছিলেন ১০ জন, ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে নারী ৮১ জন, ৬৯৫ উপসচিবের মধ্যে নারী ৩৪৯ জন, ১ হাজার ৫৪৯ জন সিনিয়র সহকারী সচিবের মধ্যে নারী ৪৫৪ জন এবং ১ হাজার ৫২৮ জন সহকারী সচিবের মধ্যে নারী ছিলেন ৪৭২ জন। দেশের ৬৪ জেলায় জেলা প্রশাসক পদে ছিলেন ১০ নারী।
১৯৭৪ সালে সাতজন নারী উপপরিদর্শক (এসআই) ও সাতজন নারী কনস্টেবল নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে নারীরা অন্তর্ভুক্ত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার পদেও নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন।
নারীদের বাদ দিয়ে এদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথ ধরেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারীর উন্নয়ন ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার, কর্মসংস্থান, সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীদের উন্নয়নে তিনি বিভিন্ন নীতি এবং কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন, যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ এবং সুদূরপ্রসারী গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের বৈশ্বিক সূচকে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন হয়েছে।
এখন বাংলাদেশের নারীরা সচিব, বিচারক, এসপি, ভিসি, ডিসি, সামরিক এবং বেসামরিক বিভিন্ন পদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নারীরা আজ বিমান চালাচ্ছেন, হিমালয় পর্বত জয় করছেন। বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি সুযোগ চায় না। নারীরা সমান সুযোগ চায়। আমাদের দেশের নারীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি যোগ্যতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রতিফলন। নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট ও প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা