
সাহিত্যে বাংলা ভাষার প্রভাব
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৩২

অন্জন কুমার রায়: একটি ভাষার প্রভাব ভাষাভাষী জনসংখ্যা এবং নির্দিষ্ট এলাকার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ভাষার নান্দনিকতার উপর নির্ভর করে না। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকে আছে। এক সময় বাংলা ভাষাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়ে উঠেনি কিংবা ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়নি। বরং আমাদের মনে তা স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বের মাঝেও বাংলা ভাষা এক অনন্য স্থান দখল করে রয়েছে। তাই ভাষাভাষীর দিক দিয়ে বাংলা ভাষা এখন বিশ্বের সপ্তম ভাষা।
বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য সকল ভাষাকে করেছে সমৃদ্ধ। একটি দেশ উপনিবেশে পরিণত হলে দেশটির ভাষা এবং সংস্কৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। উপনিবেশের অন্তর্গত দেশটির ভাষা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে পারে। লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশায়নের ফলে তেমনিভাবে অনেক দেশের ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে পর্তুগিজ এবং হিস্পানি ভাষা জায়গা করে নিয়েছে। অর্থাৎ সেখানকার প্রকৃত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে এক নতুন ভাষা স্থান করে নিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবেও কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা হারিয়ে নতুন ভাষা জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা ঘটেনি। বাংলা ভাষায় বিশ্বায়ন কিংবা উপনিবেশের ছোঁয়া লাগলেও তা সুদৃঢ স্থান করে নিয়েছে স্বকীয়তায়।
তারও বহুবিধ কারণ রয়েছে। সাহিত্য ভাষার বিকাশকে গতিশীল করতে সহায়তা করে। সেদিক থেকে বাংলা ভাষায় সৃষ্টিশীল বিকশিত সাহিত্য ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সাহিত্যের উপর নির্ভর করে ভাষার গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ সাহিত্য বিকশিত হলে ভাষা অতি সহজে স্থায়ীরূপ লাভ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলা সাহিত বাংলা ভাষাকে বাঙালির এক অভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। বাংলা ভাষার সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক কিংবা কবি সে কাজটি সম্পন্ন করেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। ফলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে বাংলা ভাষা গতিশীল হয়েছে। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে শৈল্পিক নিদর্শন আমাদের ভাষার জগতকে আরো শানিত করে তুলেছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক ইংরেজি শিক্ষা আইন প্রবতর্নের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফারসি। অর্থাৎ তুর্কি, পাঠান, মোগল আমলে ফারসি ভাষার মাধ্যমে রাজকার্য পরিচালনা হতো। রাজভাষা হিসেবে ফারসি ভাষা উপমহাদেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সেজন্য অনেক সাহিত্য ফারসি ভাষায় স্থান করে নিয়েছিল। পাশাপাশি চাকরি ও ব্যবসায়ের প্রয়োজনে ফারসি ভাষা শেখার প্রয়োজন হতো। তাই ফারসি ভাষাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা স্বতন্ত্র্য স্থান পাওয়া কঠিন ছিল। তা সত্তে¡ও মানুষের চিন্তা, চেতনা, মননে বাংলা ভাষা স্থান করে নিয়েছিল। রচিত হয়েছে বিভিন্ন বাংলা সাহিত্য। যদিও মধ্যযুগের প্রারম্ভে বাংলা সাহিত্য রচনায় ছেদ পড়ে।
গোপাল হালদারের মতে, ‘তখন বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্ক আঘাতে ও সংঘাতে, ধ্বংসে ও অরাজকতায় মূর্ছিত অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভব, সেসময়ে কেউ কিছু সৃষ্টি করার মতো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রেরণা পায়নি।’ তারপরও হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’, রামাই কানাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ বাংলা ভাষাকে বিচ্যুত হতে দেয়নি।
অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচিত হয়। এছাড়াও ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তার ব্যতিক্রমী লেখনীতে সাহিত্যের ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। তার লেখনীতে প্রচুর আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করলেও বাংলা ভাষাকে মার্জিত ও সার্বজনীন করতে সহায়তা করেছেন সাহিত্যের মাধ্যমে। সেসময়কে বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত তা সহজেই পাশ কাটিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এছাড়াও বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি ভাষার কর্তৃত্ব বাংলা সাহিত্যকে আলাদা করতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার উপর উর্দু ভাষার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইলে জনগণ তা মেনে নেয়নি। সে আমলেও বাংলা সাহিত্য এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। তবে, আধুনিক যুগের উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য স্পন্দন জাগিয়ে তুলে। যার ফলে সাহিত্য পাঠকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আধুনিক যুগের নাগরিক ও জীবনমুখী সাহিত্য বাংলা ভাষাকে এক ভিন্নমাত্রা দান করেছে। সে সময়ের বাংলা সাহিত্যে সমসাময়িক সৃষ্টিসম্ভার স্বতন্ত্র রচনাশৈলীর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে করেছে সমৃদ্ধ। যে কারণে বাংলা সাহিত্য বিশ্বদরবারে আজও সমাদৃত। তাই এ ভাষায় রচিত সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছে।
মূলত বাঙালির চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টি সামর্থ্যে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুন্দর অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে। এছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের শৈল্পিকধারা আমাদের সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেক্ষাপটও বাংলা ভাষা। এ ভাষাতেই কবি, সাহিত্যিকরা নতুন নতুন ভাবের ধারায় ও রূপচেতনার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। বৈচিত্র্যময়তার ভরপুর এ সকল সাহিত্যে প্রেম এবং পল্লীজীবনে ভাষার সৌন্দর্য ধরা দেয়। নিজের ভাষা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বাংলাভাষী অনেকটাই গর্বিত যে, আন্তর্জাতিক স্তরেও বাংলার গুরুত্ব অনেক বেশি। অথচ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সমালোচকরা বলতেন, ‘বাংলা ভাষার উপযুক্ত পাঠ্যবই নেই, শিক্ষার বাহন হবে কি করে! উপযুক্ত পরিভাষা না হলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কিংবা অফিস আদালতে বাংলা ব্যবহার কেমন করে হবে।’ বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেক ভাষা হারিয়ে গেলেও বাংলা ভাষা টিকে আছে স্বমহীমায়। বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যেমন বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রূপকেও প্রতিফলিত করেছে। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক জাগরণের চেতনা খুঁজে পাই। এছাড়াও বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বাংলা ভাষার অনেক সাহিত্য ইংরেজী ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা আজ জায়গাটুকু তৈরি করে নিয়েছে স্বীয় কৃতিতে।
লেখক: প্রবন্ধিক ও কলামিস্ট