
সংগ্রামী জীবনের আগুনঝরা দিন
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১০

ম. মানিক: ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। আমাদের সংগ্রামী জীবনের এক আগুনঝরা দিন। নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক এরশাদের ভীত কাঁপিয়ে দেয়া চির সংগ্রামী এ দেশের ছাত্রসমাজের স্বাধীনতা উত্তর গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনালগ্ন। এ এক রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল, সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অনেকটা হেলে পড়েছে। রমনা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে কয়েকটা লাল রঙের বিআরটিসি বাস নীরব নিস্তব্দ দাঁড়িয়ে আছে। বাসগুলোর চারদিক, রমনা থানার চারপাশ ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সৈন্যরা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দূরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত অসংখ্য মানুষ। তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
তারা জানে, গতকাল বিকালের শেষ প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক হাজার ছাত্রকে ভয়াবহ নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গ্রেপ্তার করে রমনা থানায় নিয়ে এসেছে। এরশাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গুলি করে অনেক ছাত্রকে হত্যা করেছে। গতকাল বিকালে পুলিশের গুলিতে নিহত জয়নালের মৃতদেহ নিয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরে বেড়িয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের থেকে প্রায় এক হাজারের মতো ছাত্রকে বাছাই করে রমনা থানায় আটকে রেখে পুলিশ রাতভর তাদের উপর নির্মম নির্যাতন করেছে। নির্যাতিত ছাত্রদের আর্তচিৎকারে ওই এলাকার ভাসমান মানুষজন কেহ রাতে ঘুমাতে পারেনি। তাদের কাছে খবর এসেছে, রাতভর পুলিশের এই ভয়াবহ নির্মম নির্যাতনে থানার ভেতরে অনেক নিরীহ ছাত্র নিহত হয়েছে, যাদের মৃতদেহ পুলিশ গুম করে ফেলেছে।
জনতার মনের ভেতর বদ্ধমূল এ ধারণা মোটেও অমূলক নয়, আমি ও আমার মতো শত শত ছাত্রনেতা রমনা থানার বন্দি শিবিরে রাতভর পুলিশের এ নির্মম নির্যাতনের নিষ্ঠুর শিকার। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, অনেক মৃত্যুর আশঙ্কায় আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত আমরা বেঁচে আছি, এটাই আশ্চর্য মনে হয়েছে। থানার সামনে মিলিটারি বেষ্টিত লাল বাসগুলোতে করে দেশের এই সাহসী দামাল সন্তানদের নিয়ে যাওয়া হবে মৃত্যুপুরীতে। বাসগুলোর সব কটা জানালা কালো কাপড়ে ঢাকা। আঘাতে আঘাতে আমাদের শরীর তখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত! প্রত্যেকের শরীরের চামড়া ফালা ফালা কাটা, ফেটে চৌচির। গায়ের সাথে জামা প্যান্ট রক্তে জমাট বেঁধে চাপটে লেগে লেপ্টে আছে। নিথর নির্জীব মৃতপ্রায় আমরা সারিবদ্ধভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুকূপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। লাল বাসগুলো আমাদের কাছে তখন মৃত্যুকূপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। আমাদের হাঁটতে বড়ই কষ্ট হচ্ছে। ডানে, ঘাড় ঘুরালেই সবেগে ফাটা বাঁশের চাবুকের তীব্র আঘাত ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। তবুও আমরা বুঝতে পারি, চারদিকে জনতার ঢল নেমেছে। তারা হাত উঁচিয়ে, দুহাত নেড়েচেড়ে, হাতের তালুতে চুমু খেয়ে আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, অভয় দিচ্ছে। মুহূর্তেই আমরা অনেকটা সতেজ সজীব হয়ে উঠি, আমাদের বুকের ছাতি গর্বে, আনন্দে ফুলে ওঠে। অনেকটা ভয়শূন্য আমরা লাল বাসের ভেতরে গিয়ে উঠি। গোধূলীর অন্তিম সময়। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুবতে বসেছে। আজ মনে হচ্ছে আকাশটা অনেক লাল, যার আভা, রক্তাভ নরম আলোকছটা, আমাদের বাসের জানালার উপর এসে পড়েছে। আমাদের বাস সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগের মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্টের দূরত্ব খুব বেশি নয়, তবুও গাড়িগুলো ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করতে রাত হয়ে যায়। একটা দীর্ঘ সময় পর আমাদের গাড়িগুলো এসএনটি ব্যাটালিয়ন ২গচ ইউিনিটের একটা গ্যারিসনের সামনে এসে থামে। সেনা সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমে যায়। সামনে একটা বড় উন্মুক্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে কিছুটা দূরে গ্যারিসনের স্থাপনা। গাড়ির ভেতর থেকে জানালা দিয়ে মাঠের দিকে তাকাই, চারদিক নিকশ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার! সব বাতি নেভানো। এটাও এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক নির্যাতন। কী এক ভৌতিক নীরবতা আমাদের স্নায়ু অবশ করে দিচ্ছে। সময় যেন থেমে থাকে, মনে হতে থাকে যেন আমরা অন্তহীন সময় ধরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। ভয়ে আমাদের শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। রাত্রি গভীর, গাড়ির দরজা খুলে যায়। দুজন সেনা সদস্য গাড়ির ভেতর উঠে আসে। ছাত্রদের থেকে একজনকে তুলে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির বাইরে ছুড়ে মারে। সাথে সাথে শপাং করে একটা তীব্র আওয়াজ, ছাত্রটি তীব্র চিৎকারে মা! মা! মা! মা! মাগো! মাগো! আর্তনাদ করতে করতে অন্ধকার মাঠের ভেতর দৌড়াতে থাকে। অনেকটা সময় ধরে আর্তনাদের শব্দ আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে।
একসময় আর্তনাদ থেমে যায়, ছেলেটির গোঙানির শব্দ শোনা যায়, অতঃপর সবকিছু নীরব নিস্তব্ধ। আমরা মৃত্যুর গন্ধ পাই। আমাদের বুকের ভেতর মৃত্যুর হীম শীতল বাতাস, ধুক ধুক অনুভূতি লকলক করে বইতে থাকে। এমনই করে ধারাবাহিকভাবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। একসময় আমার পালা আসে। আমি সাহসে বুক বেধে দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। আমি তখনও পুরোপুরি বুঝে ওঠতে পারিনি, এই দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ির বাইরে ঠিক কী ধরনের ঘটনার মহড়া ঘটে চলেছে। আমার ভাবনার জাল ছিন্ন করে একটা তীব্র থাবা এসে আমার ঘাড়ের উপর পড়ে। মুহূর্তে আমি ছিটকে গাড়ির বাইরে মাঠের ধুলাবালির উপর হুমড়ি খেয়ে উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি। গাড়ির বাইরে মুঠো করে মোটা ফাটা বাঁশের অনেকগুলো শক্ত কঞ্চি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষরূপী এক যমদূত। শপাং করে ফাটা বাঁশের তীব্র আঘাত আমার কোমর থেকে ছোঁ মেরে অনেকটা চামড়া টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। আমি মা! মা! মা! মা! চিৎকারে আর্তনাদ করতে করতে সমস্ত মাঠ দৌড়াতে থাকি। মনে হতে থাকে কারা যেন বাঁটা মরিচ আমার শরীরের ছিলা জায়গায় ডলে ডলে মাখছে। এরই মধ্যে দেখতে পাই, মাঠের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ছাত্রদের নিথর নির্জীব দেহ। তারা সকলে জ্ঞান হারিয়েছে। একসময় আমার চেতনা লোপ পায়, আমি অজ্ঞান হয়ে সবার মতোই মাঠের ধুলোবালির উপর পড়ে থাকি। ঘন ঘন পানির ঝাপটায় কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অনেকের জ্ঞান ফিরে আসে। এমনি করে কতটা সময় কেটেছে আমি জানি না। এভাবেই এরশাদ স্বৈরশাসকের সেনাবাহিনীর এসএনটি ব্যাটালিয়ান ২গচ ইউনিটের সেনা সদস্যরা আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানায়। বেঁচে থাকা আমাদের মৃত্যুর অনুভূতি দিতে দিতে তারা বরণ করে নেয়। একটা সেলের ভেতর স্বাভাবিকভাবে পনেরো থেকে বিশজনের বেশি মানুষ অবস্থান করতে পারবে না। তেমনি একটা সেলের ভেতর আমাদের একশজনের মতো ছাত্রকে গাদাগাদি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত আমরা বসতে পারছি না, দাঁড়াতে পারছি না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একজনের পা হাত মাথা শরীরের ভার আরেকজনের উপর, যেন একজনের ভেতর অন্যজন ঢুকে আছে। আমরা বেঁচে থেকেও ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর অনুভূতি পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের ধাতস্থ হতে কয়েকটা দিন সময় লাগে। এখন আমাদের কয়েকটা সেলে ভাগ করে রাখা হয়েছে। ফলে সেলের গাদাগাদি অবস্থা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ রাত ১২টার পর থেকে আমাদের চোখে ঘুম নেই। আমাদের সেলের সকলে বিনিদ্র রাত কাটাই। একুশ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার নানা গল্পে আমরা মেতে উঠি। গল্পে গল্পে রাত ভোর হয়। আমাদের সেলের বাইরেই একেবারে চোখের সামনে কদম দূরত্বে ছোট্ট পরিসরে একটা সাজানো গোছানো শহীদ মিনার।
চারিধারে অসংখ্য ফুলের টব দিয়ে একটা সুন্দর বাগান, ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। মনে হয় অসংখ্য লাল লাল ডালিয়া আর হলুদ গাঁদা ফুলের মাঝে শহীদ মিনারটা বসে আছে। আমরা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় আছি, সেনা সদস্যরা কীভাবে শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য করে, এটা দেখার জন্যে। একটা হু হু কান্না আমার ভেতর ঝড় তোলে, আলোড়িত হতে থাকে। আমার মধ্যে কি এক বোধ জন্ম নেয়। আমি স্থির থাকতে পারি না। আমি বাইরে টহলরত সৈন্যদের কাছে শহীদ বেদিতে ফুল দেয়ার ইচ্ছা জানাই। আমার কথা শুনে সৈন্যরা খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। তারা দ্রুত একজন অফিসারকে ডেকে আনে।
রক্তচক্ষুর অফিসার আমাকে সেলের বাইরে এনে চুলের মুঠি ধরে সপাটে দুগালে থাপ্পড় মারতে থাকে। অকথ্য গালা-গালি আর কয়েকজনে মিলে লাথি মারতে মারতে আমাকে শহীদ বেদিতে ছুড়ে ফেলে। আমার শরীরের ধাক্কায় ডালিয়া আর গাঁদা ফুলের কয়েকটা টব শহীদ বেদিতে আছড়ে পড়ে। সেনা অফিসার আমাকে শহীদ বেদিতে ফেলে আমার মাথা, ঘাড়, চোয়ালের কিছু অংশ বুটের তলা দিয়ে পিষতে থাকে, আর চিৎকার করে বলতে থাকে, মাদারচোদ, খানকির পোলা, শহীদ মিনার ভেতরে ঢুকাইয়া দিমু...। তীব্র ব্যথায় আমি কোকাতে থাকি। বুটের তলায় পিষ্ট আমার ঠোঁট ফেটে ফোটা ফোটা রক্ত গড়িয়ে শহীদ বেদির কিছুটা ভিজিয়ে দেয়। আমার দুচোখ ভরা জল গড়াতে থাকে।
একুশের শহীদদের বুকে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য, আমার পুষ্পার্ঘ্য।
এই প্রথম আমি ভয়হীন কষ্ট আর মানসিক আনন্দ পেতে শুরু করি।
আমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
আমার হƒদয়তন্যে বেজে ওঠে অমর একুশের গানের অমুল্য চরণ...
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবিকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কথাসাহিত্যিক