manobkantha

স্মরণে বহুগুণে গুনান্বিত মানুষ : অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী

ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস:: নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমেদ চৌধুরী গত ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। কালের গর্ভে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও কিছু কিছু মানুষ অমর হয়ে থাকেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে। তেমনি শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমেদ চৌধুরী তাঁর কীর্তির মাধ্যমে চির অমর হয়ে থাকবেন মানুষের অন্তরে।

শ্রদ্ধাভাজন অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয় ২০১২ সালে নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। সেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি সহ সিলেটের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য স্বনামধন্য আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর নাম শুনেছি বহু বছর আগে থেকেই। আমি নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শ্রদ্ধাভাজন অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে এক বছর কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী যেমন ছিলেন একজন সজ্জন ব্যক্তি তেমনি ছিলেন বিভিন্ন কর্মকান্ডে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাঁর কর্মস্পৃহা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি মৃত্যুর দেড় বছর আগে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি তখন সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে কিডনি জনিত জটিলতায় ভোগেন। ফলে মাঝে মাঝেই তাঁকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো। তিনি অসুস্থ হয়ে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি আছেন এটা জানতে পেরে তাঁকে দেখতে যাই। আমার যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই তাঁকে দেখতে আসেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। দু'জনেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন করার মধ্যে দিয়েই তাঁদের একসঙ্গে পথ চলা। সেটা স্মরণ করেন এমপি মহোদয়। সেবার তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। তাঁর দুটি ছেলে অকালেই প্রাণ হারান। স্ত্রীও পরকালে পাড়ি জমান। রোগে-শোকের মধ্যে থেকেও এই জনপ্রিয় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ গোলাপগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবে সব দায়িত্ব সুচারু ভাবে পালনের পরও প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখভাল করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই মেধাবী ছাত্র বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির সহপাঠী ও সমপাঠী ছিলেন।

ছাত্র জীবনে এডভোকেট ইকবাল আহমেদ চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৫৭ সালে সংগঠনটির জেলা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরের বছর সিলেটের এম.সি কলেজের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন করার কারণে কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তিনি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৬৬ সালে বাঙ্গালির মুক্তিসনদ খ্যাত ছয় দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ গণঅভ্যুথ্যানসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। লণ্ডন প্রবাসী তাঁর বড়ো ভাই ফারুক আহমেদ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্টজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লন্ডনে জনমত গঠনে ও ফান্ড সংগ্রহে তিনি সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে এসে চট্টগ্রামে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেন। ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী ১৯৭৩ সালে কুড়েঘর প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেন এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ফতেহউল ইসলাম চৌধুরী ও ইছমত চৌধুরী-সহ রক্ষিবাহিনীর সাথে বৈঠক করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। তিনি ১৯৯৪ সালে স্বদলবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রসারে যেমন নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তেমনি জনকল্যাণে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতি, সিলেট ডায়বেটিকস এ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি ২০০৮ সালে তাঁকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্কাউটস্ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান কর্তৃক ২০১১ সালে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০১৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ এর কাছ থেকে বাংলাদেশ স্কাউটস্-এর ২য় সর্বোচ্চ পদক ‘রৌপ্য ইলিশ’গ্রহণ করেন। এডভোকেট হিসেবে তাঁর পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে নিজ গুণে গুণান্বিত এই মহান ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দেয় । শোক সভায় মরহুম ইকবাল আহমদ চৌধূরী সম্পর্কে "সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম এমপি বলেছেন, এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধূরী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান আদর্শিক দেশপ্রেমিক নেতা।"

মহান মুক্তিযুদ্ধে এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরীর অসামান্য অবদানের কথা ও স্বাধীন বাংলাদেশে মানবকল্যাণে তাঁর ত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা ভোলা যায় না। গোলাপগঞ্জের রফিপুরের পারিবারিক গোরস্থানে স্ত্রী ও সন্তানদের পাশে চির শায়িত বহুগুণে গুনান্বিত মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।