
ফুটবলের মহানায়কের মহাপ্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৪০

পেলেই বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলকে। এই পৃথিবীর অসংখ্য স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, অগণিত ভক্ত, এই খেলাটাতে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য। একটা আস্ত পৃথিবী তৈরি করার জন্য। মহানায়কের মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো পেলের জীবনের ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে লড়াই। হারিয়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। জনতার দরিদ্রতার গল্পকে স্বপ্নের মোড়কে পেশ করেছিলেন পেলে। চায়ের দোকানে কাজ করা একটা বাচ্চা ছেলের ফুটবল পায়ে দৌড়, গোলের সেলিব্রেশন, বিশ্বকাপে চুম্বন আবেগে-অনুষঙ্গে ঢুকে পড়েছিল ব্রাজিলের, বিশ্বের। দুর্নীতি আক্রান্ত ব্রাজিল সরকার তাঁকেই ক্রীড়ামন্ত্রী করেছিলেন, ইউনেসকো তাঁকে বিশ্বদূত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। হলিউডের রুপোলি পর্দা সিলভারস্টার স্ট্যালোনের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেলিন মহানায়ক পেলেকে।
‘ফিফা’ ম্যাগাজিনের পাঠক এবং জুরি বোর্ডের বিচারে শতাব্দীর ‘শ্রেষ্ঠ’ ফুটবলার পেলে আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেলেন। কথিত আছে, ব্রাজিলের ছেলেরা নাকি জন্মের পরেই প্রথম উপহার হিসেবে পায় একটি ফুটবল। অনেকের সারা জীবন সেই গোলাকার চামড়ার বস্তুটিকে নিয়েই কেটে যায়। অনেকে আবার বড় হওয়ার পর আগ্রহ খুঁজে পায় অন্য কিছুতে। পেলের জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ব্রাজিলের মিনাস জেরাইসে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলার ডোনডিনহো। ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কর্তা টমাস এডিসনের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন। তবে ‘এডিসন’ বদলে নাম দেন ‘এডসন’। এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। ডাকনাম দেওয়া হয় ‘ডিকো’। কিন্তু তাকে ‘পেলে’ নামেই চিনল বিশ্ব। কীভাবে ট্রেস কোরাসোয়েসের ছোট্টো ছেলেটার নাম পেলে হলো, তা নিয়ে প্রচুর কাহিনি আছে। তবে পেলে নিজে জানিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় পাড়ায় প্রায়শই গোলকিপার হিসেবে খেলতেন। সেইসময় স্থানীয় খেলোয়াড় ‘বাইল’-এর সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হতো। সেই নামই ক্রমশ পালটে-পালটে পেলে হয়েছিল।
সারা বিশ্বে ফুটবলকে জনপ্রিয় করার পেছনের অন্যতম নায়ক পেলের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। ব্রাজিলের ট্রেস কোরাসোয়েসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পেলে। যে ট্রেস কোরাসোয়েসের অর্থ হলো ‘তিনটি হৃদয়’। বাবার থেকে রক্তে ফুটবল এসেছিল পেলের। তাঁর বাবা আধা-পেশাদারি ফুটবল লিগে খেলতেন। কিন্তু হাঁটুর চোটের জন্য কেরিয়ারে ইতি পড়েছিল। বাবা ফুটবলার হলেও পেলের ছোটবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। তখনকার দিনে ফুটবলাররা সে রকম বেতন পেতেন না। ফলে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট রোজগার করা তার বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাবার দেখাদেখি ফুটবলের প্রতি ছোট থেকেই ঝোঁক। পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। চায়ের দোকানে কাজ করে হাতখরচ জোগাড় করতেন। বাকি যে সময় পেতেন, রাস্তাতেই ফুটবল খেলা চলত। তবে চামড়ার ফুটবল দিয়ে নয়, এ ‘ফুটবল’ অন্য রকম। মোজার ভিতরে কাগজ পুরে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা নিয়েই খেলা চলত।
ফুটবল বিশ্বে চিরকাল অমর থেকে যাবেন পেলে। দারিদ্র্য, সাফল্য, স্বপ্নপূরণ, ব্রাজিল, এমনকি ফুটবলও হয়ে যাবে পেলে নামের সমার্থক। আর সে পেলেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে পেলে ব্রাজিলের ক্লাব স্যান্টোসে যোগ দিয়েছিলেন। যে ক্লাবে ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন। জিতেছিলেন সব ট্রফি। তারইমধ্যে স্যান্টোসে যোগ দেওয়া পেলের প্রতিভা জাতীয় দলের নজরে পড়েছিল। মাত্র ১৭ বছরেই ব্রাজিলের জার্সিতে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেছিলেন। বয়সের কারণে দলের এক মনোবিদ তাঁকে না খেলানোর কথা বলেছিলেন। পেলের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘স্পষ্টতই শিশু ও’। কিন্তু সেই ‘শিশু’-ই যে কী করতে পারেন, তা সুইডেনের মাটিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ফরোয়ার্ড হিসেবে বিশ্ব ফুটবল কাঁপিয়েছিলেন পেলে।
বাবার দেওয়া নাম এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। তবে বিশ্বের বুকে লাখো কোটি ফুটবলপ্রেমীর কাছে তিনি পেলে নামেই পরিচিত। তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ফুটবল বিশ্বের রেকর্ড এক হাজার ২৮১টি গোল, যা আজও ভাঙতে পারেনি কেউ। তাকে ফুটবলের রাজা ও কালো মানিক উপাধি দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের হয়ে খেলেন প্রথম বিশ্বকাপ। পর পর চারটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। তার মধ্যে তিন বার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বিশ্বের আর কোনো ফুটবলারের তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের নজির নেই।
বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ফুটবলার যার তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড রয়েছে ১৯৫৮, ৬২ ও ৭০ সালে। এছাড়াও দলের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল করে ব্রাজিলের সর্বকালের শীর্ষ গোলদাতাও হয়েছেন এ কিংবদন্তি। খালি পায়ে ফুটবল মাঠে পদচারণায় শুরু, বল পায়ে জাদুকরী ছোঁয়ায় গ্রাম-শহর ছাড়িয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে আলো ছড়িয়ে কেবল ফুটবলেই নয়, ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠা এক নাম পেলে।
১৯৬১ সালে ইংল্যান্ড, ইতালির বেশ কয়েকটা বড় টিম পেলের পিছনে ছুটছে টাকার থলি নিয়ে। পেলে যদি স্যান্টোস ছেড়ে চলে যান, দেশীয় ফুটবলের কী হবে? ওই ভাবনা থেকেই ব্রাজিলের সরকার পেলেকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে দিয়েছিল। তার অর্থ ছিল, পেলেকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না! বিখ্যাত ইংলিশ ফুটবল সাংবাদিক লিখেছিলেন, দে স্তেফানো তৈরি হয়েছেন পৃথিবীতে। আর পেলে, তাঁকে তৈরি করেছেন ঈশ্বর!
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস। নাইজিরিয়ায় ফুটবল ম্যাচ খেলতে চলেছে স্যান্টোস। দু’বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে নাইজিরিয়ায়। পুরো দেশ বারুদে গন্ধে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত। স্যান্টোস কি মাঠে নামতে পারবে? ব্রাজিলিয়ান ক্লাবের কর্তারাও সন্দিগ্ধ ছিলেন। কিন্তু পেলে জানতেন, তিনি মাঠে নামবেন। হয়েও ছিল তাই। পেলে নাইজিরিয়া সফরে যাচ্ছেন বলে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়। লাগোসের ক্লাবের বিরুদ্ধে পেলের মাঠে নামার সময় গ্যালারি প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল- পেলে খেলতে নামছেন, শান্তি বজায় রাখুন। ওই বছরই নভেম্বর মাসের মারাকানো দেখল এক আশ্চর্য ঘটনা। শান্তির বার্তা নিয়েই পেলে জীবন অতিবাহিত করেছিলে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোল করার রেকর্ডও তৈরি করেছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে ওয়েলসের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৩৯ দিন। ওই গোলের সুবাদেই ম্যাচ জিতেছিল ব্রাজিল।
ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিকেরও নজির গড়েছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ‘ব্ল্যাক পার্ল’। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৪৪ দিন। ফিফার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১,৩৬৬ টি ম্যাচে ১,২৮১ টি গোল করেছিলেন পেলে। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গোলের হার ছিল ০.৯৪। রেক.স্পোর্টস.সকার স্ট্যাটিস্টিক ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্রাজিলের জার্সিতে মোট ৯২টি ম্যাচে ৭৭টি গোল করেছিলেন পেলে। ফ্রেন্ডলিতে ৩৪টি, বিশ্বকাপের যোগ্যতা-অর্জন পর্বে ছ’টি, বিশ্বকাপে ১২টি, কোপা আমেরিকায় আটটি এবং অন্যান্য টুর্নামেন্টে ১৭টি গোল করেছিলেন। কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিলেন পেলে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ফুটবল সম্রাট। সুইডেনকে ফাইনালে ৫-২ গোলে হারিয়েছিল ব্রাজিল। দুটি গোল করেছিলেন স্বয়ং পেলে। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৪৯ দিন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৮ বিশ্বকাপ চলাকালে তাঁকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় দেখা যায়। সেই টুর্নামেন্টের এক মাস পরেই পেলেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের পর থেকে তিনি ডাক্তারদের কাছ থেকে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালের শেষের দিকে তাঁকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। বৃহস্পতিবার ২৯ ডিসেম্বর ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ৮২ বছর বয়সে মারা গেলেন ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি।
যে মানুষটা স্কিলের ঝলকানিতে ফুটবলকে রঙিন ও বর্ণময় করে তুলেছিলেন, সেই মানুষটার বিদায়বেলায় কিভাবে লিখব সে ভাষা তো হারিয়ে যাচ্ছে। ফুটবল তারকা নেইমার লিখেছেন, ‘পেলের আগে ১০ নম্বর ছিল শুধুই একটি সংখ্যা। আমি কোনো এক সময় কোথায় জানি এটা পড়েছিলাম। সুন্দর হলেও সেটা ছিল অসম্পূর্ণ। আমি বলতে চাই, পেলের আগে ফুটবল ছিল শুধুই একটা খেলা। পেলে সব কিছু বদলে দিয়েছে। তিনি ফুটবলকে শিল্পে বদলে দিয়েছেন, আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছেন। তিনি দরিদ্রদের, কালোদের কণ্ঠস্বর দিয়েছেন।
বিশেষ করে ব্রাজিলিয়ানদের দৃশ্যমান করেছেন। ফুটবল এবং ব্রাজিলের মানকে ওপরে তোলার জন্য রাজাকে ধন্যবাদ। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর জাদু থেকে গেল। পেলে চিরন্তন।’ পর্তুগিজ মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো লিখেছেন, পেলের পরিবার ও ব্রাজিলের জন্য আমার গভীর সমবেদনা। ফুটবলের চিরন্তন রাজার বিদায় ফুটবল-দুনিয়া যে ব্যথা অনুভব করছে তা প্রকাশ অযোগ্য। তিনি লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা। সারাজীবনের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। আমাদের মতো ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিতে তিনি থেকে যাবেন সব সময়। শান্তিতে ঘুমান রাজা পেলে।’
মানুষ মরণশীল এই চিরন্তন সত্য বাক্যকে স্বীকার করতেই হবে। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হেরে গেলেন কিংবদন্তি। ৮২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে পাড়ি দিলেন ফুটবলের রাজা। সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী পেলে। ইনস্টাগ্রামে পেলের মেয়ে লেখেন, ‘আমরা যা কিছু হয়েছি, সেটা তোমার জন্য। তোমায় অপরিসীম ভালোবাসি। শান্তিতে ঘুমাও।’ পেলের মহাপ্রয়াণে বার্তা দিতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেসি লিখেছেন, ‘শান্তিতে ঘুমান পেলে।’ দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর আমরা একটা শূন্যতা অনুভব করেছিলাম। এবার পেলেও না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এই দুই মহাতারকাকে হারিয়ে ফুটবল যেন অভিভাবকহীন হয়ে গেল। ফুটবলের মহানায়ক পেলের মহাপ্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে প্রত্যাশা করছি তাঁর দেখানো পথ ধরে ফুটবল এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।