manobkantha
৭১ এর গণহত্যা

লালমনিরহাটের গণহত্যা

৭১ এর গণহত্যা

আহসান হাবিব: জাতিগত জাগরণ চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে পাকিস্তানি শাসকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। কারারুদ্ধ করেছিল জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানকে। অতঃপর তাঁরই আহ্বানে সূচিত হয়েছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। অপারেশন সার্চ লাইটের পর হানাদার সেনারা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, এরই ধারাবাহিকতায় তারা এপ্রিলের চার তারিখে অনুপ্রবেশ করেছিল লালমনিরহাট শহরে। পরবর্তী সময়ে তাদের আগ্রাসন প্রসারিত হয়েছিল সীমান্তবর্তী হাতীবান্ধা উপজেলা পর্যন্ত। আগ্রাসনের সূচনা পর্যায় হতেই হানাদারদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত পরিসরে সংঘটিত হয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ। অতঃপর স্বাধীনতা যুদ্ধ বিকশিত হলে; বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে চূড়ান্ত পরাজয়ের ১০ দিন পূর্বেই হানাদাররা এই জেলা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

হানাদার-বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর অবাঙালি অধ্যুষিত লালমনিরহাট সদরে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ। এহেন বর্বরতা পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়েছিল অন্যান্য উপজেলায় (তখনকার থানা)। সেসময় পুরো জেলাকে তারা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। একই সময় এ জেলার বিস্তীর্ণ ভূমি পরিণত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। ৭১ এর ৮ মাস ১ দিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মোগলহাট-হাতীবান্ধাসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে। এই জেলার গণহত্যার ভয়াবহতা, ধ্বংসযজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধের বিবিধ বীরত্বপূর্ণ অনুষঙ্গকে উপজীব্য করে লিখা হয়েছে এই গ্রন্থটি। তুলে ধরা হয়েছে মহান শহিদ, বধ্যভূমি, গণকবরের পরিচিতি-অবস্থান এবং বীর যোদ্ধাদের বীরত্বগাথাসহ এলাকার ছয়দফা, ৭০ এর নির্বাচন ও যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির নানাবিধ গৌরবময় অধ্যায়। আশা করি তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ এ গ্রন্থটি সদাশয় পাঠককুল কর্তৃক সমাদৃত হবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রেলওয়ের জেলা হিসেবে খ্যাত ছিল লালমনিরহাট। তখন এখানে বিহারিদের আধিপত্য বেশি ছিল। রেলের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ তাদের দখলে ছিল। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার সুবাদে তাদের সুযোগ-সুবিধাও বেশি ছিল। তারা বাঙালিদের অনেকটা হেয় চোখে দেখত, বাঙালি মুসলমানদের মুসলমান মনে করতো না এবং নেতিবাচক অর্থে বাঙালি না বলে “বাঙাল” বলত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই জেলা শহরে প্রথম গণহত্যা শুরু হয় বিহারিদের দ্বারা।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তাদের হাতে শাজাহান নামের একজন যুবক এবং চা দোকানে কর্মরত একজন কিশোর হত্যার শিকার হয়। এরপর বাঙালিদের প্রতিরোধের মুখে বিহারিরা নিজেদেরকে সাময়িক গুটিয়ে নেয় বটে, কিন্তু ৩ এপ্রিল বিকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লালমনিরহাট শহরে প্রবেশ করার পর ৪ এপ্রিল হতে বিহারিরা হানাদারদের সহযোগিতায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের সম্মিলিত আক্রমণে প্রথম দুদিনেই কয়েক হাজার বাঙালির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের বাঙালিদেরই নৃশংস এবং অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়।

সেই গণহত্যায় নারী-পুরষ, বয়সী-অল্প বয়সী, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, শিশু, এমনকি কোলের বাচ্চারাও প্রাণহানির হাত থেকে রেহাই পায় নাই। ধারালো অস্ত্রে এক-দেড় বছরের বাচ্চাদের গলা কেটে রেলওয়ের জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করা হতো। লালমনিরহাট জেলার  সেই নারকীয়, বীভৎস্য গণহত্যার তথ্যগুলো জরিপ আকারে তুলে আনেন দিনাজপুরের সাংবাদিক ও গবেষক আজহারুল আজাদ জুয়েল। তার গবেষণা অনুযায়ী লালমনিরহাটে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫৬২টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল “গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ লালমনিরহাট জেলা” শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। এই গ্রন্থটিও সম্পাদনা করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ও রাজশাহী আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহবুবর রহমান। ১৫৪ পৃষ্ঠার অফসেট মুদ্রণে বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বইটি প্রকাশ করেছে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট, খুলনা। মুদ্রণে সুবর্ণ, ঢাকা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ও গবেষণায় অসাধারণ এক দলিল হতে পারে এই বই।

কালীগঞ্জ বধ্যভূমি, কালীগঞ্জ: শতাধিক বাঙালিকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী বধ্যভূমিতে হত্যা করা হতো। এটি ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভ‚মি। এ ছাড়া কে ইউ পি ডিগ্রি কলেজের পাশে রয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলার বড় গণকবর।

বিডিআর লাইন বধ্যভূমি, কাশীগঞ্জ: লালমনিরহাটে বিডিআর লাইনের সামান্য দূরে রয়েছে একটি বৃহৎ বধ্যভ‚মি। এখানে পাকিস্তানি সেনারা এক দিনে ৩২ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে ফেলে রাখে।

রেলস্টেশন রিকশাস্ট্যান্ড বধ্যভূমি: রেলস্টেশনের পশ্চিমে ওভারব্রিজের নিচে অবস্থিত শানবাঁধানো রিকশাস্ট্যান্ড ছিল লালমনিরহাট শহরের প্রধান বধ্যভ‚মি। এখানে বহু লোককে হত্যা করা হয়। ডিভিশনাল অফিসের দক্ষিণে একটি জলাভ‚মিতে ফেলে দেওয়া হয় অসংখ্য লাশ। গুলিতে আহত রেলকর্মী আবুল মনসুর আহমদ সেখানে কমপক্ষে আড়াইশ মানুষের লাশ দেখেছেন।

ডিভিশনাল অফিস জলাভূমি বধ্যভূমি: লালমনিরহাটে পাকিস্তানি বাহিনী শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য লাশ এনে ডিভিশনাল অফিসের দক্ষিণে একটি জলাভ‚মিতে ফেলে দিত।

বড়বাড়ির হাট গণকবর: লালমনিরহাটের বড়বাড়ির হাট এলাকায় ছড়ানো-ছিটানো অনেক গণকবর রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী এলাকার অন্তত ১০০ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে বিচ্ছিন্নভাবে এই গণকবরে মাটিচাপা দেয়।

সাহেবপাড়া গণকবর: লালমনিরহাটের সাহেবপাড়া এলাকার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অনেক গণকবর। এই গণকবরগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে ৫০ জন শহীদকে সমাহিত করা হয়।

হাতীবান্ধা গণকবর: এখানে বিভিন্ন জায়গায় থেকে এনে প্রায় ১৫০-২০০ মানুষকে কবর দেওয়া হয়।

মানবকণ্ঠ/এআই