
সালেক খোকনের নতুন বই ‘বীরত্বে একাত্তর’
- ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৮

মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসীদের জীবনসংগ্রামসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন, জনপদ থেকে জনপদে যার ঘুরে বেড়ান সালেক খোকন তাদের মধ্যে অন্যতম। সংসার চালাতে চাকরি তার মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে তিনি চলে যান দূর থেকে দূরান্তে তার গন্তব্যে- মানুষের কাছে। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কাজ অনন্য। যেসব যোদ্ধা মাটির মানুষের জন্য -একটা স্বাধীন দেশের জন্য জীবনকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল দেশ স্বাধীন করতে, হানাদার বাহিনী মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। সেইসব বীর সন্তান যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল ভূমিকা পালন করলেও পরে বেছে নিয়েছিলেন মৌন ভূমিকা। যারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীন দেশ পায়নি বলে অভিমানে নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। মন ও শরীরের ক্ষত নিয়ে নির্বাসন নিয়েছিলেন অন্তর্গত ভেতরে। সালেক খোকন তাদের কাছে ছুটে গিয়ে তুলে আনেন তার মুখনিঃসৃত কথামালা। যা মুক্তিসংগ্রামের অনন্য সব দলিল।
সালেক খোকন- বুকের ভেতরে যার বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের দলিল তুলে আনা যারা ব্রত- এমন ভাবেই তিনি ঘুরে বেড়ান দেশের পথে-প্রান্তরে। ১৯৭১ সালের মহামুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি জনযুদ্ধ। যাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রুখতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলো মজুর, কিষান, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষ। ছিলো পুলিশ, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর যারা পালিয়ে এসেছিলো ক্যান্টমেন্ট থেকে বা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলো তারাও সামিল হয়েছিলো দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় বরণ করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে। ঘটনার ঘনঘটা এখানেই শেষ নয়। দেশ স্বাধীন হলেও মুক্তিযুদ্ধেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা চুপ করে রইলো না। তারা স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে মরণ কামড় হানলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় পরিবার পরিজনসহ নির্মমভাবে। দেশকে প্রোপাকিস্তান তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রথ যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সেই মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখেন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে ওড়ে তার লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলাতে থাকে ৭৫ পরবর্তী স্বাধীনতাবিরোধীদের ইচ্ছামতো। এরপরে ক্ষমতা বদল হলেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি আজও শেষ হয়নি। সালেক খোকন এসময় মাঠের লড়াকু সৈনিকদের মুখ থেকে শোনা কথা তুলে এনেছেন । যেসব কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক একটি অনন্য দলিল হিসাবে কাজ করবে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম তারিখেই কথা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেখক ও মুক্তিযুদ্ধগবেষক সালেক খোকনের নতুন গবেষণাগ্রন্থে ‘বীরত্বে একাত্তর’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই গ্রন্থে জানা যাবে, একাত্তরে কীভাবে গেরিলারা ঢাকায় পেট্রোলপাম্প উড়িয়ে দিয়েছেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধ যুদ্ধ, একজন সাবসেক্টর কমান্ডারের বীরত্ব ও পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরে এয়ারফোর্স পাইলটদের অব্যক্ত ইতিহাস, কীভাবে গেরিলার হাতে নিহত হন পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খান ওরফে মোনায়েম খান, কী লেখা ছিল আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুদের লালচিঠিতে, সৈয়দপুরে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞ, গ্রামের নাম কেন বদলে হয় আরশাদগঞ্জÑএকাত্তরের এমন অজানা ঘটনা। অভিনব এই গ্রন্থে একাত্তরের চারজন বীরপ্রতীক, সাতজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ইতিহাস সরল গদ্য আলোকচিত্রসহ তুলে ধরা হয়েছে।
বীরত্বে একাত্তর গ্রন্থটি নিয়ে কথাপ্রকাশের কর্ণধার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার প্রয়াসে লেখক ও গবেষক সালেক খোকন কাজ করছেন এক যুগেরও অধিক সময় ধরে। নিভৃতচারী লেখক নিরলস প্রচেষ্টায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত মানুষের কথা শোনাতে ব্রতী হয়েছেন, যারা ছিলেন অন্তরালে। একাত্তরে এ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভ‚ত করেছিলেন যারা, এমন সতেরোজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বের
ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছে বীরত্বে একাত্তর গ্রন্থটি। গ্রন্থভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং অকুতোভয় বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সতেরোজন মুক্তিযোদ্ধার অকুতোভয় সাহস ও গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের অজানা ঘটনা রয়েছে এই গ্রন্থে। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত বাঙালির সবচেয়ে রক্তাক্ত, আত্মত্যাগের মহিমাময় প্রকৃত ইতিহাস। গল্পের ছলে বলে যাওয়া সেসব রোমহর্ষক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্লভ আলোকচিত্র। বুকের গহিনে লুকিয়ে থাকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনন্য আলেখ্য গ্রন্থটি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এমন গ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরে আমরা গর্বিত।’
সালেক খোকন তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা কাজে যুক্ত রয়েছেন বহু বছর ধরে। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক’ পুরস্কার অর্জন করে। তার এ বইটি ইতিহাসের অন্যতম একটি দলিল হয়ে থাকবে এ প্রত্যাশা করি।
মানবকণ্ঠ/এআই