manobkantha
বিজয়ের মাস

লড়াইটা হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের

বিজয়ের মাস

ডিসেম্বরের এদিনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খুশি করতে পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিক নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় না। বাংলার মানুষ তখন অপেক্ষায়, কবে আসবে মহামুক্তির দিন। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান।

এদিকে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এ উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে আকাশে বাংলাদেশ ও মিত্র তথা যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হয়Ñ মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো সারাদিন ধরে অবাধে বাংলার মুক্ত আকাশে ওড়ে। পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান। দুপুরের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় হানাদার পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রায় সব বিমান। মুক্তি-মিত্রবাহিনীর বিমান বাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়।

১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর অগ্নিঝরা বিজয়ের আরেকটি কারণে স্মরণীয় ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এদিন ঢাকার আশপাশে গেরিলা বাহিনীর সম্মুখ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয়ের দিন গুনতে শুরু করে। সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান। এ সময় বিশ্ব নেতাদের চোখে রাজনীতির এক নতুন প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ। চারদিকে বিজয়ের রণধ্বনি।

অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী বাসাবাড়ির ছাদে উঠে প্রকাশ্য দিবালোকে এই বিমান যুদ্ধ দেখে এবং পাকিস্তানি বিমানের পতন দেখে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে, পৃথিবীর বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা এই প্রথম। কারণ বিমান আক্রমণের সময় সাধারণত বেসামরিক জনগণ ট্রেঞ্চ বা পরিখায় প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়। আর আজ বিজয়ের আনন্দে ঢাকার মানুষ বাড়ির ছাদে উঠে বিমান যুদ্ধ দেখছে। মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে হানাদার পাকিস্তানিদের ঢাকার সুরক্ষিত কুর্মিটোলা বিমানবন্দর অকেজো হয়ে পড়ে। একটি হাজার পাউন্ড বোমার আঘাতে বিমানবন্দরে ২০ ফুট ব্যাসের একটি বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটে পালাতে থাকে। বিজয়ের বেশে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী। সাড়ে সাত কোটি মানুষ মহান বিজয়ের অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে।

আখাউড়ায় প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার- মুক্তির প্রতীক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। আখাউড়ায় চলছে বিজয় উল্লাস, পাকিস্তানিদের বড় শক্ত ঘাঁটি আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর মানুষ জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আনন্দ ও বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে।

আখাউড়ার যুদ্ধে মিত্রবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লে. কর্নেল বেগসহ ৬ জন সেনাবাহিনীর অফিসার, ৮ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ও একশ আর্মি ও প্যারা মিলিটারি ফোর্সের ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। এখানে মিত্র-মুক্তিবাহিনী দুটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ও প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ভারত ও রাশিয়া বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধে সব ধরনের সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে চ‚ড়ান্ত বিজয়ের পথে বাঙালি মুক্তি সেনারা এগিয়ে চলে।

মানবকণ্ঠ/এআই