manobkantha
৭১ এর গণহত্যা

সৈয়দ মাহমুদপুর বধ্যভূমি

৭১ এর গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের টগবগে যুবক-যুবতী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শক্তিশালী পাক হানাদারদের খতম করার লক্ষ্যে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আমাদের সম্বল ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। পরে ভারতে ট্রেনিং শেষে কিছু গ্রেনেড, স্টেনগান জোগান পেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা।

যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা নামক বাজারে ছিল পাক সেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এই বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হরিহর নদীর ওপারে মাহমুদপুর গ্রাম। যশোর-সাতক্ষীরা ভায়া চুকনগর মহাসড়কের চিনেটোলা বাজার থেকে পূর্বদিকে ২/৩শ’ গজ দূরেই স্থানটির অবস্থান। যশোর থেকে একটি দল বিভক্ত হয়ে ডুমুরিয়া হয়ে খুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বিল পাড়ি দিতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল ডুমুরিয়া থেকে একটি বড়দল তাদের সাথে যোগ দিয়ে খুলনায় অপারেশনে যাবে। সে সময় খুলনায় পাক বাহিনী ব্যাপক অপারেশন চালাচ্ছিল। তাদের মোকাবিলার জন্যই এদের সংগঠিত হয়ে যাওয়া। খুলনার নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুটপাট, নিধন ঠেকাতে খুলনার উদ্দেশে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, রবিশাল এবং বাগেরহাট থেকে আরেকটি বড় দল কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে এদের সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিধিবাম। পাঁচজনের এই দলটি যখন চিনেটোলা নামক স্থানে গভীর রাতে পৌঁছায় তখন দুর্ধর্ষ রজাকার কমান্ডার মালেক ডা. তাদের খবরটি পেয়ে যায়। পাক সেনাদের সাথে নিয়ে কর্ডন করে ধরে ফেলে এদেরকে। এরা ছিল কমিউনিস্ট জেলা পর্যায়ের নেতা মাশিকুর রহমান তোজো, আসাদুজ্জামান আসাদ, সিরাজুল ইসলাম শান্তি, আহসান উদ্দিন খাঁন মানিক এবং ফজলুর রহমান ফজলু।

এদেরকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে রাজাকাররা। রাতে তাদেরকে সেখানে অমানবিকভাবে গায়ের চামড়া বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেখানে লবণ দিয়ে গুলি না করেই বেয়নেটের খোঁচায় হত্যা করা হয়।

রাতে এই বাজারের মুদি দোকানদার কেনারাম এবং বেচারামের দোকানে একজন কুলি থাকতো। তার নাম শ্যামাপদ দেবনাথ। তাকে দিয়ে গ্রাম থেকে শাবল কোদাল জোগাড় করিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে তার মধ্যে পুঁতে রাখা হয় এই পাঁচজনের মৃতদেহ। পরে এলাকাবাসী আলাদাভাবে এদের কবরস্থ করে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের বাসিন্দা এখন তারা। নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ জায়গায় রেনট্রি গাছগুলো ছায়া দিয়ে তাদের শান্তিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে।

চোখের সামনের সে দিনের সেই স্মৃতি আজও ঘুমের মধ্যে শ্যামাপদকে বিচলিত করে তোলে। ছুটে যায় সমাধিস্থলে। হাত বুলিয়ে একটু শান্তির পরশ পায়। শ্যামাপদ বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ। হাজারো পর্যটক প্রতিদিন আসে এখানে। শ্যামাপদের সাথে কথা বলে। কিন্তু শরীরে কুলোয় না তার। শ্যামাপদ বলে মুুমূর্ষু অবস্থায় পানি চাইলে রাজাকাররা প্রসাব করে তাদের দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল। চামড়হীন অবস্থায় তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। এ সময় শ্যামাপদ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। গামছা দিয়ে চোখ মুছে নেয়। সে স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে তাকে।

কমিউনিস্ট পার্টি দলের পক্ষ থেকে এই পাঁচটি কবর ইট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে। প্রতি বছর ২৩ অক্টোবর এখানে জড়ো হয় হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার এ পর্যন্ত এই পাঁচ তেজস্বী শহীদের ন্যূনতম খবর নেয়নি, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই