manobkantha

‘তুমি মানুষ হয়ে তার পাশে দাঁড়াও’

সবুজ সিলেট, হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ এখন পত্রিকার সংবাদ। প্রতিদিন  সেখানের অসহায়, খাদ্যহীন, বানভাসি মানুষের কান্নায় বাতাস ভারি হচ্ছে। মানবিকতার বিপর্যয় চলছে। সুনামগঞ্জের সব উপজেলা উজান ঢলে বিপর্যস্ত। একই অবস্থা সিলেটের। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ। পত্রিকার পাতা উল্টালে বা টেলিভিশনে বন্যার সচিত্র প্রতিবেদন দেখলে চোখ ভিজে যায়। মানুষের এত কষ্ট মানুষ হয়ে কিভাবে দেখা যায়? গবাদি জীবনের সঙ্গে মানুষ যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

মেঘালয়-আসামে অতিবৃষ্টির ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারি বর্ষণে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক বন্যায় জনদুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতিপূর্বে বন্যার সময় ধান ভেসে গেছে কৃষকের, এবার বাড়িঘর, পুকুরের মাছ, সবজির খেত সব। প্রথম বন্যার সময় আমরা দাবি তুলেছিলাম হাওরে স্থায়ী বাধ নির্মাণের । কারণ প্রতিবার বন্যা আসে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই ক্ষতি পোষাতে না পোষাতে আবার বান আসে। কিন্তু এবারে যে বান এসেছে তা কস্মিনকালেও দেখেনি মানুষ। আজ সহজেই মনে পড়ে সেই বাঘ আসা মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের কথা। বাঁধ হবে বাঁধ হবে প্রতিবার পরিকল্পনা হয়। তারপর থেমে যায় সব। এবার যে বন্যা হয়েছে তাতে সরকার আগামীতে বাঁধ নির্মাণ করবে কিনা সেটা বড় কথা নয়। এবার যে ভয়াল বন্যা থাবা দিয়েছে সেটাকে প্রতিরোধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে যদিও ভাবা হয়েছিল বন্যা সিলেট ও সুনামগঞ্জে। এবার কিন্তু উত্তর জনপদ,  ময়মনসিংহ অবধি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের ভিতরে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসাবে পরিচিত। এখানে নদী-হাওর- বাঁওড়-পুকুরের আধিক্য সবচে বেশি। এখানে অজস্র আধুনিক নৌপথ- রেলপথ, ভারতের পানি রাজনীতির সমাধান হতে পারতো। মাছ ও ফসলের বিশাল জোগানদাতা হাওরের পাড়ে হাওর রক্ষা বাঁধ হতে পারতো। তা না হয়ে হয়েছে সড়কপথ। এর পেছনে বিভিন্ন পরিকল্পনা আছে।

বিদেশি গাড়ি কোম্পানিগুলোর গাড়ি বিক্রির ফন্দি আছে। জনগণের দৃশ্যমান উন্নয়নের কারণে আমাদের নদীপথের অর্ধেক নেই। আমাদের নদী প্রতিদিন দখল দূষণের মুখোমুখি। হাওর অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্য নেই। গ্রীষ্মের মৌসুমে এগুলো প্রায় শুকিয়ে যায়। যে কারণে ঢলের পানি নদীতে পড়ে আর সময় নেয় না। নদীর পেটে সে জায়গা নেই। ফলে ডুবিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রতিবছর এতে কৃষকের ক্ষতি হয়। কৃষকের ক্ষতি হলে এমনকি-এভাবেই চলছিল। এবারে কামড় দিয়েছে বন্যা। বন্যার আকার এতই ভয়াবহ যে, সিলেটে সামরিক বাহিনী নামানো ছাড়া বাহ্যত কোনো কাজ চোখে পড়ছে না। অথচ দুর্গত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। তারা কোথায় যাবে কি করবে? সিলেটে এর মাঝেও নৌকার মাঝিরা ১ হাজার টাকার পথ যেতে ৮ গুণ টাকা চাইছে। তারপরও নৌকার অভাব। নৌকার অভাবে জলমগ্ন মানুষের উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি কোন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। সিলেটে মোমবাতি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে। এটা কেন বাড়বে সে কথা বলছে না কেউ। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটের পাশাপাশি স্যানিটেশন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বয়স্ক, নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। না খেয়ে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় নলকূপ পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষজন স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই বানের পানি পান করছেন। এ কারণে যেকোন সময় ডায়রিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেয়া হচ্ছে না।

দুর্ভোগের শিকার মানুষের একটি অংশ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই পেলেও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে অধিকাংশ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। আশ্রয়ের জন্য সর্বত্র হাহাকার দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। এই ত্রাণ চাহিদার ধার-কাছ দিয়েও যাচ্ছে না। বন্যাদুর্গতদের দাবি-চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি তারা পাচ্ছেন না। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এসব কারণে বন্যাদুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের আর্তনাদে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ এখন একদম অচেনা দুই জনপদ। যত দূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। মানুষের চোখের পানি এই দৃশ্যের কাছে হার মানে। সড়কগুলো হারিয়ে গেছে পানির নিচে। সিলেট মহানগরের বেশিরভাগ এলাকা, সুনামগঞ্জ পৌরশহর পুরোটা এবং দুই জেলার অন্তত ২০টি উপজেলায় বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ৪০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার তাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালা কিংবা কলার ভেলায়। অনেক এলাকায় পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরের ধান-চাল, আসবাব, গবাদিপশু।

দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকট। মানুষ কত অসহায় জীবন যাপন করছে, কিভাবে বেঁচে আছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। ৫০ লাখ মানুষের এই সংকট ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। বানের পানিতে কোনোমতে ভেসে থাকা মানুষ উদ্ধারের আর্তি জানাচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে অসহায় মানুষের কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের দুর্গতি দেখে কষ্টে বুক ভেঙে যায়। চালার ওপরে বসা মানুষ অসহায় আর্তি করছে উদ্ধারের। উদ্ধারকৃতরা চাচ্ছে খাদ্য। এমনকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হওয়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। এছাড়া খাদ্যগুদামের আশপাশে পানি থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সেখান থেকেও খাদ্যসামগ্রী বের করা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বত্র ত্রাণ পাঠাতে চেষ্টা চলছে। জেলায় মোট ৩৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০টি কেন্দ্রের আশ্রয়গ্রহণকারীদের তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে রয়েছে। সে হিসাবে ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ হাজার ৮৪৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বা পানীয় জলের তীব্র সংকট। নগরীতে আশ্রয় কেন্দ্র খুললেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। এটা অভাবনীয় বিপর্যয়। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। দুর্গত মানুষের সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক বাহিনীসহ সাধারণ মানুষ। দেশের প্রত্যেকটি মানুষ সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইলেও সার্বিক অবস্থার কারনে পারছে না। তবে বৈরী আবহাওয়া, প্রবল স্রোত, টানা বৃষ্টি, নেটওয়ার্কহীনতা সত্ত্বেও সেনা সদস্যরা বন্যাকবলিতদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।  দ্রুত এই পানি নেমে যাবে না বলে ধারণা বিশেষজ্ঞ মহলের। বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ সহসা কমবে না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হবে। পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে সেনাবাহিনী । তারা ত্রাণ ও চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছে। সেনাবাহিনী প্রধান বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে সেনা সদস্যদের বলেছেন, কষ্ট যতই হোক মানুষের দুর্ভোগে লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’ কিন্তু মানুষ যতটা ফেসবুকে লিখছে, তার একাংশ সাহায্য পেলে বানভাসি মানুষেরা উপকৃত হতো।

পানি কমতে শুরু করায় দুর্ভোগ আরো বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে, তবে বেড়েছে কানাইঘাটে। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে। তবে বন্যার পানি যত কমবে মানুষের দুর্ভোগের পরিমাণ ততই বাড়বে। দেখা দেবে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ও খাদ্য সংকট। ধনী -দরিদ্র সবই এখন নিঃস্ব। মানবিক বিপর্যয় নেমে আসছে ধীরে। সারাদেশবাসী এগিয়ে না গেলে এই বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়। ৫০ লাখ মানুষ দুর্গত-এটা যা তা কথা নয়। মানুষ বড় অসহায়। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিঃস্ব মানুষের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে আসে । এই মুহূর্তে  সিলেট-সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা একান্ত জরুরি। সেটা না হলে পরবর্তীতে খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা সংকটের যে ঢেউ আসবে তা ঠেকানো কষ্টকর হয়ে পড়বে। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান, যে যেভাবে পারেন। মানুষ বড় একা, মানুষ কাঁদছে। তুমি মানুষ হয়ে তার পাশে দাঁড়াও। এই আকুতি করা ছাড়া আর কি আছে?

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই