manobkantha

সাইবার অপরাধ ও প্রচলিত আইন

একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে সহজলভ্যতার বস্তুতে পরিণত হয়েছে ইন্টারনেট। কিশোর-কিশোরী, যুবক, বৃদ্ধ সবাই আজ নেট দুনিয়ায় চরম ব্যস্ত সময় দিনাতিপাত করছে। প্রযুক্তিকে স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার নিজের অজান্তেই প্রযুক্তির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্ব আজ পরিণত হয়েছে হাতের মুঠোয়। যেটাকে প্রযুক্তির ভাষায় বিশ্বগ্রাম বলা হয়। বিশ্বগ্রাম হলো, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর এমন একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যেখানে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষই একটি একক সমাজে বসবাস করে। কার্যত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাই হলো বিশ্বগ্রাম। তবে যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে অন্তর্জালে যুক্ত হতে গিয়ে কেউ আবার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়ছে ভ্রান্তির-জালে। আর এভাবেই অপরাধের ডিজিটাল রূপান্তর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যার একটি হলো সাইবার অপরাধ।

বর্তমান সময়ে যেসব ইস্যু মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দু তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাইবার অপরাধ। সাধারণ অর্থে সাইবার অপরাধ হলো, এমন একটি অপরাধ যা মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন: হ্যাকিং, ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত তথ্যফাঁস, নারী নির্যাতন, ব্ল্যাকমেইল, অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা ইত্যাদি। অর্থাৎ ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনের আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অপরাধমূলক অভিপ্রায় নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির উদ্দেশ্যে আইন বহির্ভূতভাবে সৃষ্ট অপরাধকে ‘সাইবার অপরাধ’ বলে। সাধারণত যে ব্যক্তি এই অপরাধ সংগঠন করে তার নিশানাতেও থাকে অন্যের মোবাইল বা কম্পিউটার। তাই একে ‘কম্পিউটার ওরিয়েন্টেড ক্রাইম’ বলেও অভিহিত করা হয়। দেশে সংঘটিত সাইবার অপরাধের আখড়া হয়ে উঠছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক। কেননা ফেসবুক বা যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানিকর, বিভ্রান্তিমূলক, অশালীন, অরুচিকর, অশ্লীল, আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক কিছু লেখা বা মন্তব্য করা কিংবা ছবি বা ভিডিও আপলোড করা সাইবার অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। সাইবার অপরাধের সূত্রপাত ঘটে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক আবিষ্কারের পর থেকে। সুতরাং এটি আমাদের জন্য নতুন কোনো অপরাধ নয়। কেননা আমরা সবাই কম বেশি ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। আর ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আমরা মোটামুটি সবাই অপরাধটি সম্পর্কে জ্ঞাত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। আর এ অপরাধের শিকার হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ার্নেস ফাউন্ডেশনের’ তথ্যমতে, সাইবার অপরাধে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম ১০.৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম ৭৩.৭১ শতাংশ। এছাড়াও ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে এ অপরাধের শিকার ১২.৭৭ শতাংশ নারী জনগোষ্ঠী।

সাইবার অপরাধ প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: ব্যক্তি সংক্রান্ত সাইবার অপরাধ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত সাইবার অপরাধ। প্রথমত ব্যক্তি সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের মধ্যে রয়েছে, সাইবার পর্নোগ্রাফি, সাইবার স্টকিং, সাইবার ডিফেমেশন ইত্যাদি। সাইবার স্টকিং বলতে বোঝায়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এক বা একাধিক প্রোফাইলের মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির কার্যকলাপ সামাজিক নেটমাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে তবে তা স্টকিংয়ের আওতায় পড়ে।’ অন্যদিকে সম্পত্তি সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের মধ্যে রয়েছে অনলাইন জুয়া, ফিশিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ইত্যাদির মতো নানা ধরনের অপরাধ। ফিশিং (চযরংযরহম) হলো, ‘প্রতারণার মাধ্যমে কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন ব্যবহারকারী নাম, পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করাকে বোঝায়।’

এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য সাইবার অপরাধ হলো, অনলাইনে ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত করে মন্তব্য, কম্পিউটার অ্যাবিউজ, আইপি স্পুফিং, কম্পিউটার ভাইরাস, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক আইডি তৈরি, পাসওয়ার্ড অনুমান করে আইডি হ্যাক ইত্যাদি। আইপি স্পুফিং (ওচ ংঢ়ড়ড়ভরহম) বলতে বোঝায় ‘হ্যাকারের মাধ্যমে কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অন্য কোনো কম্পিউটারে আইপি অ্যাড্রেস পাঠানো।’ সাইবার অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি পরিভাষা হলো সাইবার বুলিং। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করাকে ‘সাইবার বুলিং’ বলে। অর্থাৎ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কারো ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা ইত্যাদি হলো সাইবার বুলিং। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। সাইবার বুলিং স্বতন্ত্র কোন অপরাধ নয় বরং সাইবার অপরাধেরই একটি অংশ। বর্তমানে উঠতি বয়সী তরুণেরা বিশেষ করে মেয়েরা প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। ফলশ্রæতিতে অনেক তরুণ তরুণী মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের মতো জঘন্য পথ বেছে নিচ্ছে।

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০১৩ সালে সাইবার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। স¤প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা এসেছে ৩ হাজার ৩২৪টি। তার মধ্যে ২০২০ সালে ৬২২টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালে এসেছে ৩টি মামলা।’ এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত থানা থেকে মোট মামলা এসেছে ৩১৬টি। বর্তমানে ট্রাইবুনালে প্রায় দুই হাজার ৪৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার ৬০টি মামলা থানা থেকে এসেছে এবং বাকি ৩৯০টি ট্রাইবুনালে করা হয়েছে। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল জানিয়েছে, সাইবার অপরাধের কারণে শুধু ইউরোপেই বছরে ক্ষতি হয় অন্তত ৯২৯ বিলিয়ন ডলার? অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন গড়ে অন্তত এক মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় সাইবার অপরাধীদের দ্বারা।

সাইবার নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও বিচারের উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’। অন্যদিকে একই উদ্দেশ্য ২০১৫ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ১৪ ধারাতে উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত (অন্তরঙ্গ) ছবি তোলে ও প্রকাশ করে তাহলে তিনি ১০ বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অন্যদিকে যদি কোন ব্যক্তি প্রতারণার অভিপ্রায়ে প্রেরকের বরাবরে এমন কোন ইলেকট্রনিক মেসেজ প্রেরণ করে যেটা বস্তুগতভাবে ভুল তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষতির মুখে নিপতিত করে তাহলে তিনি এই আইনের ১০ ধারানুযায়ী অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও অত্র আইনের ১৫ ধারানুযায়ী, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমে শিশু পর্নোগ্রাফি বা শিশু সম্বন্ধীয় অশ্লীল উপাদান সংরক্ষণ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ তে সাইবার অপরাধ রোধে নানাবিধ শাস্তির বিধান আলোচিত হয়েছে। অত্র আইনের ২৭ ধারাতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধে চিহ্নিত হলে সে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একইভাবে এই আইনের ২৮ ধারাতে বলা হয়েছে, ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করে কোন মন্তব্য করলে অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্যের জন্য মানহানি বা অপমানজনক হয় এমন মন্তব্য করতে ব্যক্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তৎসত্তে্বও কেউ যদি কারো মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করে তাহলে সে অত্র আইনের ২৯ ধারানুযায়ী অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও এই আইনের ৩৪ ধারামতে যদি কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং করে তাহলে সেটা একটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেইসঙ্গে অপরাধটি সংঘটনের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আধুনিক বিশ্বে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আবিষ্কার একদিকে যেমন আশীর্বাদ অন্যদিকে তেমনি অভিশাপও বটে। কেননা এটির দ্বারা আমাদের যুবসমাজ তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার অমানিশায়। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজের সকল শ্রেণির ব্যক্তি পেশার মানুষ। বিশেষ করে নারীরা। সাইবার অপরাধ রোধে সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগ্রণী ভ‚মিকা পালন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলার জন্য পূর্বে ঢাকায় একটিমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ছিল। সম্প্রতি দেশের ৮ বিভাগে ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। এটি অবশ্যই সাইবার অপরাধ রোধে বাংলাদেশ সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ বলে মনে করি। কার্যত এ অপরাধের লাগাম টানতে দেশে যে প্রচলিত আইন রয়েছে সেগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সর্বোপরি সাইবার বুলিংয়ের শিকার তরুণ তরুণীদের মনোবল শক্ত করতে পরিবারকেও সচেতন হতে হবে। এভাবেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাইবার অপরাধকে রুখে দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

মানবকণ্ঠ/এসকে