
লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালান ২১ লাখ চালক
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০২:২৬

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর হিসেবে সারা দেশে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ গাড়ি রয়েছে ৪৪ লাখের বেশি। এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন মাত্র সাড়ে ২২ লাখ চালক। সেই হিসেবে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ চালক কোনো লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা দুরূহ। তাদের মতে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির পাশাপাশি অবৈধ-অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত লাইসেন্সবিহীন চালকদের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। আর এসব অবৈধ চালকদের জন্য সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। এ কারণে অনেকেই লাইসেন্স পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাপা বন্ধ থাকায় ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারছেন না তারা। ফলে আটকে রয়েছে লক্ষাধিক গ্রাহকের ড্রাইভিং লাইসেন্স। জানা যায়, প্রিন্টিংয়ের জন্য ব্যবহ্যত ‘ডুয়েল ইন্টারফেজ পলিকার্বনেট কার্ডটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনো অনুমোদন না পাওয়ায় লাইসেন্স প্রিন্ট বন্ধ রয়েছে।
স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদনকারীদের অভিযোগ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন আগে বিআরটিএতে পরীক্ষা দিয়েছেন তারা। এরপর ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে অস্থায়ী রোড পারমিট দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ১০-১১ মাস যাবৎ দুই-তিন দফা এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে না বিআরটিএ। দীর্ঘ সময়ে কাগজে লেখা অস্থায়ী রোড পারমিটের অনুমতিপত্র ময়লা হয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মেয়াদ শেষে লাইসেন্সের খোঁজ নিতে গেলে কর্তৃপক্ষ আবারো মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু লাইসেন্স কবে দেয়া হবে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের এক নম্বর ভবনে লাইসেন্স শাখায় গিয়ে অসংখ্য আবেদনকারীর সমাগম দেখা যায়। কেউ ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার সিরিয়ালে রয়েছেন। কেউ আবার স্থায়ী রোড পারমিটের কাগজ তুলছেন। ভবনের পাশে ১২০ নম্বর কক্ষে ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহীতাদেরও সিরিয়াল দেখা যায়। তবে তারা কেউ লাইসেন্স পাননি। সবাইকে নতুন তারিখ নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।
এ সময় কথা হয় রবিন আহসান নামে একজন লাইসেন্স আবেদনকারীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছর মার্চে লার্নার ফরমের মাধ্যমে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের (অপেশাদার চালক) আবেদন করেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস পর তিনি বিআরটি এর লিখিত, মৌখিক এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নির্ধারিত তারিখে ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে একটি অস্থায়ী রোড পারমিট হাতে পেয়েছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর লাইসেন্স দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ ছিল। কিন্তু বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ তাকে লাইসেন্স দিতে পারেনি। দ্বিতীয় দফায় তার অস্থায়ী রোড পারমিটের মেয়াদ গত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় বিআরটিএ। ওই তারিখেও লাইসেন্স পাননি তিনি। আবারো তার অস্থায়ী পারমিটের মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে বিআরটিএ।
এ বিষয়ে রবিন বলেন, মোটরসাইকেল চালাই আমি। সড়কে এখন আইনের অনেক কড়াকড়ি। মাঝে মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ লাইসেন্স দেখতে চায়। তখন লাইসেন্সের পরিবর্তে বিআরটিএ’র দেয়া অস্থায়ী রোড পারমিট দেখাতে হয়। বারবার এটা দেখাতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদনের পর বেশি হলে চার-পাঁচ মাস সময় লাগার কথা। কিন্তু তা পেতে আমার এক বছরের বেশি সময় লাগছে। লাইসেন্স নিতে গেলে তারা বলছে এখনো ছাপা হয়নি অথবা আসেনি। লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে এখন হয়রানিতে আছি।
বিআরটিএ র লাইসেন্স শাখার কর্মকর্তারা সবাইকে বলেন, রোড পারমিটের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়ে যান। লাইসেন্স পেতে হলে ২০২০ সালের জুন মাসের পর পাবেন। কারণ লাখ লাখ আবেদন এখনো পেইন্ডিং রয়েছে। কারো লাইসেন্সই ছাপা হয়নি।
এদিকে লাইসেন্স না থাকায় চালকরা গাড়ি নিয়ে বেপরোয়া আচরণ করেন। ফলে সড়কে এক প্রকার পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি এবং আহতের সংখ্যা বাড়ছে। বড় বড় ঘটনার পর জনতা ফুঁসে উঠলে কয়েকদিন সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ে। ইস্যু থেমে গেলে ফের পুরনো চেহারায় ফিরে যায় পরিবহনের সার্বিক ব্যবস্থা।
সড়কে নৈরাজ্যের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হয়েছেন রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু। এ ঘটনায় সারাদেশ কেঁপে ওঠে। আন্দোলনের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, পুলিশ এবং পরিবহন মালিক-চালকদের টনক নড়ে। অনুসন্ধানে পরিবহন খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, বেআইনি কর্মকাণ্ডের তথ্য বেরিয়ে আসে। সংসদে পাস করা হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন। এরইমধ্যে আইনের বাস্তবায়নও হতে শুরু করেছে। ট্রাফিক পুলিশ নতুন আইনে মামলা জরিমানা করছে। সড়কে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। বুয়েটের এআরআই’র তথ্য অনুযায়ী গত বছর সারা দেশে ৩ হাজার ৫১৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭৬ জন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৭১৫ জন। প্রতিষ্ঠানটি আরো বলেছে, ২০১৮ সালে দুর্ঘটনা ছিল আরো কম। সে বছর সারা দেশে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৬৪টি। এতে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৫২৯ জন, আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৯ জন।
জানা গেছে, বুয়েট কেবল সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দুর্ঘটনার এই তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাস্তবে দুর্ঘটনার ঘটনা আরো বেশি। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে অসংখ্য দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ হারানো ছাড়াও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা পঙ্গুত্ববরণ করছেন। হচ্ছেন বিকলাঙ্গ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালক। অদক্ষ, প্রশিক্ষণহীন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। এর জন্য দায়ী চালকের বেপরোয়া মনোভাব। চালকের অধৈর্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও ক্লান্তি দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। একজন চালকের দিনে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর নিয়ম থাকলেও চালান ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে বা বেশি যাত্রীর আশায় চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান ও রেষারেষিতে লিপ্ত হন। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর শক্তি ধরে রাখতে অনেক চালক মাদক নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ও এর আশপাশের জেলায় দিনভিত্তিক গাড়ি ভাড়ায় চালান চালকরা। কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহনে তারা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। মালিক ও শ্রমিক নেতারাও অনেক ক্ষেত্রে চালকের ত্রæটির কথা স্বীকার করেন।
তারা জানান, দুর্ঘটনার জন্য বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও দায় রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান কঠোর ভ‚মিকা নিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আমাদের দেশে সড়কে দুর্ঘটনা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা। বাসের রুট পারমিট দেয়া হয় অবৈজ্ঞানিকভাবে। চালকদের লাইসেন্স দেয়া হয় অবৈধ পন্থায়। এসব দেখার কোনো লোক নেই যেন। তিনি আরো বলেন, একটি রুটে কতটি বাস চলতে পারবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয় না। আবার কম পুঁজি নিয়ে অনেকে পরিবহন ব্যবসায় নামছেন। তারা অল্প সময়ে বেশি মুনাফা পেতে চান।
যে কারণে চুক্তিতে বাস ছাড়া হয় চালকের কাছে। চালক লাভ করার জন্য অল্প সময়ে বেশি আয় করতে চান। ফলে বেপরোয়া গাড়ি চালনা আর রেষারেষি দেখা যায় সড়কে। অল্প ক’টি কোম্পানি পরিবহন ব্যবসায় থাকলে নিয়ন্ত্রণ যেমন সহজ হতো, তেমনি পরিবহন সমিতির দরকার হতো না। কোম্পানিগুলোই বাসের রুট পারমিট ও ফিট নিয়মিত করাত। নিজেদের স্বার্থে চালকদের প্রশিক্ষণ দিত। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ভারি যানের একটা লাইসেন্স পেতে ৬-৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এটা লাইসেন্স গ্রহণে উৎসাহ কমিয়ে দেয়।
বিআরটিএ’র সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) একেএম মাসুদুর রহমান বলেন, লাইসেন্স কার্ডের অনুমতির জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে। অনুমতি পাওয়া গেলে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে নতুন টেন্ডার ডাকা হবে। টেন্ডার পাওয়া কোম্পানি পুনরায় লাইসেন্স ছাপার কাজ শুরু করবে।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, পরিবহন খাতে বিশেষ করে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে বিদ্যমান আইন ও বিধির প্রয়োগ। আমরা কমিটি গঠন করে দিয়েছি। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে কার্যক্রম চলছে।
মানবকণ্ঠ/এমএইচ