১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশের জন্ম। পাকিস্তান আবার দুইভাগে বিভক্ত হয়- একটা পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্ম নেয়ার পূর্বেই এর রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ‘পূর্ব বাংলা’ পূর্ব পাকিস্তান নামে এবং সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পরিচিতি লাভ করে পশ্চিম পাকিস্তান। ‘সিন্ধি’, ‘বেলুচ’, ‘পাঞ্জাবী’, ‘পোস্তু’ ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। অন্যদিকে ‘বাংলা’ ভাষাভাষী মানুষ বাস করে পূর্ব পাকিস্তানে। আবার আরেক হিসাবে পুরো পাকিস্তানে অর্ধেকের বেশি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।
পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষা হচ্ছে অন্যতম। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। সুতরাং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব করেন। আর এতেই নতুন করে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কেননা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মেনে নেয়া মানে পাকিস্তানের দাসত্ব করা। তাদের এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হকসহ আরো বেশকিছু বুদ্ধিজীবী। লেখালেখি হয় বিভিন্ন সংবাদপত্রগুলোতে।
তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা ‘মিল্লাত’ তাদের একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, ‘মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।’ এছাড়াও বাঙালিরা সকল প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। সেসময়ে দৈনিক ‘আজাদি’ পত্রিকায় লেখক ও সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকরির যোগ্যতা লাভ করবেন এবং প্রত্যেকটি বাংলাভাষীই চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন’। আর বাংলার মানুষের জন্য এটি মেনে নেয়া কখনোই সম্ভব ছিল না। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ‘দিলরুবা’ পত্রিকার প্রকাশক এবং এতে স্কেচ আঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। সেগুলো বিকাল পাঁচটার মধ্যে কাগজে ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজগুলো বিলি করেছিলেন। কাগজগুলো মানুষের হাতে হাতে পৌঁছায়। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মিছিল, মিটিং, ও অবরোধ গড়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। পুলিশ তাদের প্রতিরোধ ও ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতার অবিরাম আন্দোলনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।
১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। আর এরমধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে আমাদের মাতৃভাষা- বাংলা। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমানে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিনটিকে প্রতিবছর পালন করে আসছে। আজ আমরা গর্বিত যে বাংলা ভাষা সারাবিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি এলেই রক্ত পলাশ ফোটে। বাঙালির চিন্তায় ভেসে ওঠে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাণ ভিজানো গান, অমর সুরের দীপ্ত কথামালা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’
একুশ আমাদের অহংকার- আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments