
বাংলাদেশের সম্ভাবনা সীমাহীন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তরুণ জনসংখ্যা এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের স্বপ্ন, সব কিছুই যেন এক নতুন দিগন্তের দিকে ইঙ্গিত করে। অথচ এই স্বপ্নপূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি নীরব ও মারাত্মক সংকট, ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার। আমাদের দেশের মেধাবী, সৃজনশীল এবং দক্ষ জনশক্তি যখন একের পর এক বিদেশমুখী হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠে আসে, এই মূল্যবান মানুষগুলোর অনুপস্থিতি কীভাবে প্রভাব ফেলছে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন যাত্রায়? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, এই মানুষগুলো যদি ফিরে আসেন, তাহলে কি আমরা প্রস্তুত তাদের সঠিকভাবে গ্রহণ করার জন্য?
স¤প্রতি যিনি এই প্রশ্নগুলোর মাঝে একটি আশাব্যঞ্জক উত্তর হয়ে উঠেছেন, তিনি আশিক চৌধুরী। দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে, এইচএসবিসি ব্যাংকে, সহযোগী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করপোরেট নিরাপত্তা, আরামদায়ক জীবন এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তার এই ফিরে আসা কেবল একটি চাকরি পরিবর্তন নয়; এটি একটি শক্তিশালী বার্তা, যদি সঠিক পরিবেশ, সম্মান ও সুযোগ দেয়া যায়, তাহলে দেশের মেধা আবারও দেশের জন্য কাজ করতে পারে। তার নেতৃত্বে দেশে এসেছে স্টারলিংক, ঘঅঝঅ-র সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তার উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের সাথে চুক্তি হয়েছে, যারা এই বছর ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং চলছে ১০টি বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ। এসব উদ্ভাবনী ও কার্যকর উদ্যোগ তাকে শুধুমাত্র একজন প্রশাসক নয়, বরং এক নতুন যুগের অনুপ্রেরণায় পরিণত করেছে।
তবে আশিক চৌধুরীর এই ফেরা এখনো একটি ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। প্রশ্ন হলো, এমন কতজন ফিরে আসছেন? কিংবা আদৌ ফিরতে চান? বাস্তবতা হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশি পেশাজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, বছরের পর বছর ধরে দেশের বাইরে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছেন। এই মানুষগুলোর অনেকেই বাংলাদেশে ফিরতে চান, কিন্তু ফেরার পথটি এতটাই অনিশ্চিত, জটিল এবং অপরিচিত যে অধিকাংশই থেকে যান প্রবাসে।
শুধু উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। এই শিক্ষার্থীদের বড় অংশই উন্নত বিশ্বে থেকে যাওয়ার পথ বেছে নিচ্ছেন। ইউনেস্কোর সর্বশেষ (২০২৩) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৫৮ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন এবং বেশিরভাগই আর ফিরছেন না। অনেকে গবেষণার সুযোগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং কর্মক্ষেত্রের স্বচ্ছতা পেয়ে সেখানেই নিজেদের গড়ে তুলছেন। এই বাস্তবতা থেকেই বলা যায়, ব্রেইন ড্রেইন কেবল একক ব্যক্তি বা পরিবারভিত্তিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতার ফল। যদি দেশের অভ্যন্তরে যথাযথ গবেষণাগার, পেশাগত নিরাপত্তা, বেতনের প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া যেত, তাহলে হয়তো এই মেধারা আজ দেশে থাকতেন।
তরুণদের নিয়ে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ তরুণই সুযোগ পেলে দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চান। এর পেছনে কেবল উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষাই নয়, বরং আছে একটি গভীর আস্থার সংকট। একটি মেধাবী মানুষ চায় স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ, চায় তার দক্ষতার মূল্যায়ন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এখনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনীতিকীকরণ, পেশাদারিত্বের অভাব এবং গবেষণায় বাজেট ঘাটতির কারণে এই চাহিদাগুলো পূরণ হয় না। তবে সমস্যা যত বড়ই হোক, সমাধানের পথও রয়েছে, যদি তা আন্তরিকতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়।
আশিক চৌধুরীর মতো যারা বিদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং পরে দেশে ফিরে আসতে চান, তাদের সংখ্যা বাড়াতে হলে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসী পেশাদারদের জন্য একটি ‘রিটার্নিং ট্যালেন্ট পলিসি’ প্রণয়ন করা জরুরি, যার মাধ্যমে তাদের জন্য আলাদা কর সুবিধা, নির্দিষ্ট গবেষণা তহবিল, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় সম্মানজনক পদের সংরক্ষণ এবং দ্রæত আমলাতান্ত্রিক সহায়তা নিশ্চিত করা যায়।
বিশ্বের অনেক দেশ এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারত ‘ব্রেইন গেইন’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রবাসী ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষণা তহবিল, রিসার্চ চেয়ারের ব্যবস্থা, এবং বিশেষায়িত হাব গড়ে তুলেছে। চীন ‘হায়েন প্রজেক্ট’ নামে একটি বৃহৎ কর্মসূচি নিয়েছে যেখানে তারা বিদেশফেরত চীনা পেশাজীবীদের দেশে এনে স্টার্টআপ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি খাতে যুক্ত করছে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াও সরকারি সহায়তায় ‘ট্যালেন্ট হাব’ গড়ে তুলেছে, যেখানে প্রবাসী দক্ষ নাগরিকরা দেশে ফিরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশও চাইলে এই ধরনের একটি কাঠামো দাঁড় করাতে পারে। শুধু চাই সাহসিকতা, সুপরিকল্পনা এবং মেধাবীদের প্রতি সম্মান দেখানোর সদিচ্ছা। একটি জাতীয় ‘ট্যালেন্ট ডেটাবেইস’ তৈরি করে বিদেশে থাকা পেশাজীবীদের খুঁজে বের করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। একই সঙ্গে তাদেরকে সরকারের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে টেকসই উন্নয়নের অংশীদার বানানো যায়। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। দেশে ফিরে এলে অনেকে নিজ পরিমণ্ডলে অবহেলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা ‘অন্যরকম’ চোখে দেখার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। আমরা যদি তাদের সত্যিকারের মূল্যায়ন না করি, সমাজে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি না দিই, তবে তারা ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই তা বাতিল করে দেবেন। দেশে ফিরেও যেন তারা এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ না করেন, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশে ফিরে আসা অনেক প্রবাসী পেশাজীবীকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক বা নীতিগত জটিলতা নয়, বরং সামাজিকভাবে জবাবদিহিতার এক অদৃশ্য চাপে পড়তে হয়। “কেন ফিরলেন?”, “এখানে কী পাবেন?”, এমন প্রশ্নগুলো অনেক সময় তাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত করে। তাই সমাজে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা জরুরি, যেখানে একজন বিদেশফেরত পেশাজীবীকে সন্দেহ নয়, স্বাগত জানানো হবে। প্রবাসে থাকা অন্যদের কাছে এটাই হবে একটি শক্তিশালী বার্তা, দেশে ফিরে এলেও সম্ভাবনা ও সম্মান উভয়ই পাওয়া সম্ভব।
আশিক চৌধুরী কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি হয়ে উঠতে পারেন একটি অনুপ্রেরণা। তার মতো আরো অসংখ্য আশিক চৌধুরী ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। এসব আশিক চৌধুরীদের গল্প আমাদের জানাতে হবে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে, জাতীয় গণমাধ্যমে এবং সামাজিক প্লাটফর্মে। যাতে করে নতুন প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শেখে, দেশেই সাফল্য অর্জন সম্ভব। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় একটি ‘গেøাবাল বাংলাদেশি ইনিশিয়েটিভ’ যুক্ত করে বিশ্বের প্রতিভাবান বাংলাদেশিদের সঙ্গে একটি সক্রিয় সংযোগ গড়ে তোলাও সময়ের দাবি।
ব্রেইন ড্রেইনের এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি ‘মেধাবান বাংলাদেশ’ নির্মাণের কৌশল। রাষ্ট্রের উচিত একে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা। কারণ অবকাঠামো দিয়ে একটি দেশ গড়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় মূলত তার মানুষের মেধা, মনন ও নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব যারা দিতে পারেন, তাদের ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমগ্র সমাজেরও। ব্রেইন ড্রেইন কোনো সময়ের ফ্যাশন নয়; এটি একটি ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ। এই ক্ষরণ থামাতে না পারলে উন্নয়নের সব পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়বে। তবে এখনো সময় আছে, যদি আমরা আশিক চৌধুরীদের উদাহরণকে ছড়িয়ে দিতে পারি, যদি আমরা বিদেশে থাকা প্রতিটি সম্ভাবনাময় মেধার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারি। আর মেধা যদি ফিরে আসে, তবেই বদলাবে বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Comments