Image description

বাংলাদেশের বাঙালি নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ এবং হিন্দু নববর্ষ প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে শকাব্দ, বঙ্গাব্দ এবং বাংলা নববর্ষ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। পণ্ডিতগণ দুটো শকাব্দ ব্যবহার করে থাকেন, প্রথমটির নাম পুরনো শকাব্দ যা আদর্শ তারিখটি অস্পষ্ট, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দিকে কেননা প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন শিলালিপিগুলোয় এই সময়টি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। আরেকটির নাম ৭৮ খ্রিস্টাব্দের শকাব্দ বা শুধু শকাব্দ যার স্বপক্ষে দক্ষিণ ভারতে প্রমাণাদি পাওয়া যায়। এর সমান্তরাল উত্তর ভারতীয় পঞ্জিকা সালটি হচ্ছে বিক্রম সংবৎ যা বিক্রমী বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত হতো।

বাংলা সনকে বলা হয় বাংলা সংবৎ বা বঙ্গাব্দ, এখানে একটি শূন্য বছর আছে, যা শুরু হয় ৫৯৩/৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে। এটি যদি পহেলা বৈশাখের আগে হয় তবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির খ্রিস্টাব্দ বা সাধারণ অব্দের বছরের তুলনায় ৫৯৪ বছর কম, অথবা পহেলা বৈশাখের পরে হলে ৫৯৩ বছর কম হবে। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে একজন সামন্ত রাজা। তবে পরে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম গৌড়ভ‚মির শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রাজা শশাঙ্ক মারা গিয়েছিলেন ৬৩৭ বা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। এর মোটামুটি ৪৫ বছর আগে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন এবং তখন থেকেই (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করা হয় - এটা ধরে নিলে ওই তত্ত্বটা অনেকটা মিলে যায়। কারণ বঙ্গাব্দর সঙ্গে খ্রিস্টীয় অব্দের ব্যবধানও ঠিক ৫৯৩ বছরের। 

এই মুহূর্তে যেমন ১৪৩২ বাংলা সাল শুরু হচ্ছে, আর সেটা ইংরেজি বা খ্রিস্টীয় ২০২৫ সাল- ফলে গণনার ব্যবধানটা ৫৯৩ বছরের। বঙ্গাব্দ শব্দটি আকবরের সময়কালের চেয়ে বহু শতাব্দী পুরনো দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় যে আকবরের সময়ের অনেক আগে থেকেই একটি বাংলা বর্ষপঞ্জি বিদ্যমান ছিল। আমরা যে বর্তমানে পহেলা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ পালন করি তার প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরের নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। দীন-ই-ইলাহী ধর্মের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের ধর্মীয় চেতনা ও রাজনৈতিক অভিলাষ পূর্ণ করা এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্তে তারিখ-ই-ইলাহী বিন্যাস করেন। 

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, ফতেহউল্লাহ শিরাজি কিন্তু নতুন পঞ্জিকাটি চালু করার সময় চান্দ্রমাসের আরবীয় মডেল ব্যবহার করেননি, করেছিলেন পারস্য মডেল, যা শকাব্দের মতোই সৌরমাসভিত্তিক ছিল। ১৫৮৫ সাল থেকে ফতেহউল্লাহ শিরাজি উদ্ভাবিত এ নতুন সাল ‘ফসলি সন’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সাল নাম ধারণ করে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলা মাসের নামগুলো নেয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শকাব্দ থেকে: ১. বিশাখা থেকে বৈশাখ। ২. জাইষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ। ৩. আষাঢ়া থেকে আষাঢ়। ৪. শ্রাবণা থেকে শ্রাবণ। ৫. ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র। ৬. আশ্বিনী থেকে আশ্বিন। ৭. কৃতিকা থেকে কার্তিক। ৮. পূস্যা থেকে পৌষ। ৯. আগ্রৈহনী থেকে অগ্রহায়ণ। ১০. মাঘা থেকে মাঘ। ১১. ফাল্গুণী থেকে ফালগুণ। ১২. চিত্রা থেকে চৈত্র। ‘তারিখ-এ-ইলাহি’র আগে বাঙালিরা প্রচলিত শকাব্দ অনুযায়ী চৈত্র মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ব্যবহার করতেন। ৯৬৩ হিজরিতে হিজরি পঞ্জিকার প্রথম মাস ‘মহররম’ বৈশাখ মাসে শুরু হয়, তার সঙ্গে মিল রেখে চৈত্রের বদলে বৈশাখকেই ধরা হয় ‘তারিখ-এ-ইলাহির’ প্রথম মাস।  

বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মোটামুটি একমত যে, ১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের শাসনামল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছিল। বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির অন্যতম সদস্য অপরেশ কুমার ব্যানার্জি বলেন আগে বাংলায় বছরের শুরু হতো অগ্রহায়ণ দিয়ে, কারণ তখন কৃষকের ঘরে ফসল আসতো। কিন্তু খাজনা আদায়সহ নানা কিছু চিন্তা করেই বাংলা সন পহেলা বৈশাখ থেকে নির্ধারণ করা হয়। বাংলা সন নিয়ে গবেষণা করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক শারমিন রেজওয়ানা গণমাধ্যমে জানান, “তখন কর দেয়ার সময়ে ফসল উঠতো না। 

ফলে কৃষকদের কর দিতে সমস্যা হতো। সে কারণেই সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখের প্রথা প্রচলন করেন। আর শশাঙ্কের শতাব্দের সাথে বাংলা সনের সাথে মিলও খুব কম,” ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমির তত্ত্ববধানে ও ড. মুহাম্মুদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার করা হয়। ড. শহীদুল্লাহ বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র ৩০ দিনে গণনার সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে তিনি কেবল লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের অতিরিক্ত দিনটি ফাল্পুন মাসে জুড়ে দেয়ার কথা বলেন এবং লিপ ইয়ার গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী বিবেচনা করতে বলেন। সরকার শহীদুল্লাহর প্রস্তাবগুলো মেনে নিয়ে ১৯৮৭ থকে তা সরকারিভাবে চালু করে। তারপর থেকেই বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালন করা হয়।

পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণির এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। আবার কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। বিভিন্ন মত পার্থক্য থাকা সত্তে¡ও একসময় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বড় আয়োজন ছিল এই নববর্ষ উদযাপন। নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব শুভ ও সুন্দরের পথে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট