Image description

বৈশাখ এলেই আমরা জেগে উঠি, যেন ঘুমন্ত কোনো জাতিসত্তা হঠাৎ একদিনের জন্য কেঁপে ওঠে। আমরা বাঙালি হই, একদিনের বাঙালি। সারা বছর নীরব থাকা আত্মপরিচয়ের কণ্ঠস্বর হঠাৎ পহেলা বৈশাখে উচ্চারিত হয়। সেদিন আমরা মুখোশ পরে নাচি, গাই “একদিন বাঙালি ছিলাম রে!” আজ পহেলা বৈশাখ। শহরজুড়ে লাল আর সাদা, ঢাকের বাদ্য, মুখে হাসি, হাতে পান্তা-ইলিশের প্লেট। অথচ কোথাও একফোঁটা চেতনার ঘ্রাণ নেই। যেন আমরা বাঙালি নই-বাঙালির অভিনয় করি!

পহেলা বৈশাখ কি কেবল মুখোশের বাঙালিয়ানা? না কি হৃদয়ের গভীরে চেপে থাকা চেতনার এক অভ্যুদয়? এই প্রশ্ন এখন বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমরা পান্তা-ইলিশের দেশে জন্মেছি, অথচ আজ পাস্তা-পিজ্জায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বাঙালিয়ানার পথ কি তবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে? আমি ভাবি-বৈশাখ কি সত্যিই আসে? না কি আমরা একদিনের জন্য তাকে ডেকে আনি, তারপর ৩৬৪ দিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখি? একদিন ছিল, বৈশাখ মানেই ছিল হালখাতা। বটতলায় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইত মানুষ, “ও ভাই, নববর্ষ আইল রে!” তালপাতার পাখা হাতে, বৌয়ের খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে, চোখে স্বপ্ন, হাতে গ্রামীণ গন্ধ। আজ সেই বৈশাখ হারিয়ে গেছে-অথচ আমরা বৈশাখকে সাজিয়ে ফেলেছি শহুরে পোশাকে, কাচের জানালায় বন্দি করে। বৈশাখ মানে তো শুধু দিন নয়- এটা রক্তে মিশে থাকা এক ?’চিন্তা’। এটা সেই নারী, যে দুপুরবেলায় পিঠে বড়শি গাঁথা স্বামীর জন্য ঘরে বসে থাকে। বৈশাখ তার প্রতীক্ষা। 

বৈশাখ সেই কৃষকের, যার হাতের ফাটলে জমে থাকা মাটির চিহ্নে লেখা হয়-‘ভবিষ্যৎ’। আজ সেই বৈশাখ নেই। আছে ফটোসেশন, ফুড ফেস্ট, ফেসবুক লাইভ আর ইনস্টাগ্রাম রিল। বাঙালিয়ানা এখন ‘কনটেন্ট’। চেতনা নয়-‘ট্রেন্ড’। এক সময় বৈশাখ মানেই ছিল গ্রামের খোলা মাঠে বসা বৈশাখী মেলা। বাবা-দাদার হাত ধরে মেলার মাঠে গিয়েছি-হাতে বায়োস্কোপ, পুঁতির মালা, বাঁশির সুর, আর কাচের চুড়ির ঝমঝম। মেলার ভেতরে নাগরদোলা আর পুতুলনাচের এক অন্য জগৎ। ঢেঁকি ছাঁটার খেলা, গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা, লাঠিখেলা-সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত, লোকজ উৎসব। মেলার পাশে খোলা আকাশের নিচে বসত হালখাতার আয়োজন-নতুন খাতা খুলে দোকানদার কাস্টমারদের মিষ্টিমুখ করাত। গাছতলায় বসে যাত্রাপালা চলত, যার ভাষা, সুর ও ছন্দে ছিল এক অবিস্মরণীয় বাঙালিয়ানা। আজ সেই মেলাগুলো বিলুপ্তির পথে, আর শিশুদের জন্য সেই অভিজ্ঞতা গল্প হয়েই রয়ে গেছে।

বছর ঘুরে বৈশাখ আসে, আর আমরা ক্ষণিকের বাঙালি হয়ে যাই! বাঙালি হতে দিগ্বিদিক ছুটি। পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরে তো হাঁটার জায়গাও থাকে না। বাঙালি হতে অনেকেই ঘর থেকে ছোটেন পহেলা বৈশাখের এই দিনে। আমি আবার একদিনের বাঙালি হতে চাই না। বৈশাখের ওই বিশেষ দিনটাতে সকালে পান্তা, শুঁটকি ভর্তা, ইলিশ খাই না। ওসব বছর ধরেই খাই। শহরে থাকলেও শরীর থেকে গাঁয়ের (গ্রামের) গন্ধ মুছে যায়নি এখনও; মন থেকে মুছে ফেলিনি বাঙালিয়ানা। ঘণ্টা, মাস, বছর ধরেই নিজেকে বাঙালি ভাবি। পূর্বপুরুষ তো যথার্থই বাঙালি ছিল। চিন্তা, পরের প্রজন্ম নিয়ে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব আর বিদেশি মিডিয়ার সর্বগ্রাসী দৌরাত্ম্যে দিন যত গড়াচ্ছে, ভাবি ছেলেগুলো বাঙালি থাকবে তো? ভিনদেশি দাপটে ওদের বাঙালি রাখাই তো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে কখনো মুড়িমুড়কি, কড়িমুড়ালি, নিমকি কিংবা জিলাপি এনেছিতো আমার ছোট ছেলেটা ভেংচি কাটে। ওদের এগুলো মোটেও পছন্দ নয়। বড় ছেলেটাতো বলেই ফেলে, বাবা এগুলো ব্যাকডেটেড খাবার। রাগ করি না। ভাবি ওদের কি দোষ? আমরাই তো ওদের সাহেব বানিয়ে ফেলেছি। ওরা বলে পান্তায় নাকি লাখ লাখ ব্যাক্টেরিয়া জন্মে।

আধুনিক ঢাকায় বৈশাখ মানে রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান। সকালে সাদা পাঞ্জাবি-লাল পাড়ের শাড়িতে সজ্জিত মানুষ ঢল তোলে এই ঐতিহ্যবাহী স্থানে। “এসো হে বৈশাখ” ধ্বনিতে মুখরিত হয় চারপাশ। তবে এই আয়োজনও অনেকের জন্য এখন ছবি তোলার স্পট বা সেলফি স্টেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গান হয়, কিন্তু মনোযোগ কম। সেখানে ‘চেতনার প্রকাশ’ কম, ‘দেখানোর চেষ্টা’ বেশি। রমনার আশপাশে এখন আর সেভাবে বই কিংবা পুতুল কিনতে পাওয়া যায় না, বরং ফুড কোর্ট আর ব্যান্ড শোর হুল্লোড় বাড়ছে। লাল-সাদা জামার নিচে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা।

আগে বৈশাখের আগের দিন থেকেই বাড়িতে চলত পরিষ্কারের ধুম। দাদি-মা হাতে আলপনা দিত উঠানে। মা নিজ হাতে বানাতেন চিতই পিঠা, মুড়ি-মুড়কি, আর খেজুর গুড় দিয়ে পান্তা ভাত। পান্তার পাশে থাকত ইলিশ বা শুঁটকি ভর্তা। কাপড় ইস্ত্রি করা থাকত আগের দিনই, যাতে সকালে উঠে সবাই স্নান করে, নতুন জামায় বৈশাখ পালন করতে পারে। এখন অবশ্য জামা-কাপড় কিনে ফেলা হয় এক সপ্তাহ আগে থেকেই, এবং মেন্যু ঠিক হয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার মতো করে। ঘরোয়া সেই আত্মিক প্রস্তুতির জায়গা নিয়েছে ক্যাফে, ফুড ফেস্ট আর পারফেক্ট ইনস্টাগ্রাম ছবি তোলার তাড়া। আজকের প্রজন্ম অনেকেই পান্তাকে ‘ব্যাকডেটেড’ ভাবছে। কেউ বলে এতে ‘লাখো ব্যাক্টেরিয়া’। অথচ আমাদের দাদা-নানারা এই খাবার খেয়েই শতায়ু হয়েছিলেন। 

এখন ঘরে মুড়ি, খিরাই, মিষ্টি আলু, বা বিচিকলা আনলে অনেকেই নাক সিঁটকায়। এর দায় কি কেবল ছেলেমেয়েদের, নাকি আমরাই ওদের সাহেব বানিয়ে ফেলেছি? আগে নববর্ষ এলেই শুরু হতো ঘরদোর ধোয়া-মোছার ব্যস্ততা। ছোট-বড় সবাই মিলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় হাত লাগাতো। যেন নতুন বছরের আগমনে পুরনো সব জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে এক নতুন শুভ সূচনার প্রস্তুতি। উঠান ঝাঁট দেয়া, জানালার কাচ মুছে ঝকঝকে করা, বিছানার চাদর পরিবর্তন, এমনকি পুরনো পেঁচানো আলমারিও খুলে ঝেড়ে ফেলা হতো। সেই সঙ্গে চলত গাছপালায় পানি দেয়া, টব পরিপাটি করে সাজানো, সবমিলিয়ে একধরনের আত্মিক আনন্দ মিশে থাকত এই প্রস্তুতিতে।

আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মেলা দেখা ছিল এ উৎসবের অনিবার্য অংশ। দূর-দূরান্ত থেকে আপনজনরা এসে জমায়েত হতেন বাড়িতে। কেউ আসতেন গরুর গাড়িতে, কেউবা রিকশা-ভ্যানে করে। কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মিশে যেত দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির শূন্যতা। দাওয়াত দেয়া, একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব, পুরনো স্মৃতি রোমন্থন, সবকিছুতেই একধরনের ঘরোয়া মমত্ত্ব ও সামাজিক সংহতির ছোঁয়া থাকত। অনেকটা যেন হৃদয়ের আলিঙ্গন হতো সবার সঙ্গে। গানের আসর মানেই ছিল লালনের ভাবগম্ভীরতা, রবীন্দ্রনাথের সূ² আবেগ, আর হাছন রাজার অন্তরস্পর্শী কথা। রাতের বেলা উঠানে বসে একতারা হাতে গান গাওয়া হতো। কেউ একতারা বাজাতো, কেউ দোতারা, আবার কারও হাতে থাকত ঢোল কিংবা খঞ্জনি। সেসব গান ছিল আত্মার সাথে কথোপকথন, কেবল বিনোদন নয়, ছিল একধরনের আত্মদর্শন। অনেক জায়গায় তখন লোকগানের দল আসত, তারা বাড়ির উঠানে বসে গেয়ে যেত “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” বা “কে তুমি নন্দিনী”-এসব চিরায়ত বাণী।

এখন শহুরে ফ্ল্যাটে ‘বৈশাখ স্পেশাল’ প্যাকেজের নামে অর্ডার করা খাবার। ডিজে সাউন্ডে ফিউশন গান, লালনকেও তুলে ধরা হয় ড্রামের তালে। ‘বৈশাখী ফ্যাশন’ মানে বিদেশি ডিজাইনের অনুকরণ। লোকজ আনন্দকে প্রতিস্থাপন করছে ব্যান্ড কনসার্ট ও ফ্যাশন শো। বর্তমান সময়ে বৈশাখ মানেই যেন কৃত্রিম আনন্দ। হাছন রাজার গানেও গিটার-বাঁশির মিশ্রণ, লালন সাঁইয়ের গানেও পাশ্চাত্য সুরের হস্তক্ষেপ। বাংলা গানের আত্মিকতা হারিয়ে যাচ্ছে “আউ আউ মার্কা” টিভি গানের ভিড়ে। আমাদের উত্তর প্রজন্ম বাংলা গান, নাচ ও নাটকের স্বাদ নিতে নিচ্ছে বিদেশি ফিল্টার। বৈশাখের গান এক সময় ছিল আত্মার খোরাক। বাউল, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, সব ছিল আমাদের মাটি ও মানুষের গান। আজ সেই গানও ডিজে সংস্কৃতির মোড়কে পরিবেশিত হচ্ছে। 

গিটার ও সিন্থেসাইজারে লালন কীভাবে টিকে থাকবে? এই ‘মডার্নাইজেশন’ কি সংস্কৃতির পরিপোষক, না ভাঙন? আগে বৈশাখ মানেই ছিল গ্রামীণ খাবার: পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ, বেগুন ভর্তা, শুঁটকি ভুনা, আর গুড়ের পায়েস। এখন অনেকেই স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে এগুলো পরিহার করছেন। অথচ এই খাবারগুলো কেবল খাবার নয়, সংস্কৃতির অংশ। এর জায়গা নিচ্ছে পিজ্জা, বার্গার, স্যান্ডউইচ। এই বদল আমাদের শেকড় থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। পহেলা বৈশাখ শুধুই একটা উৎসব নয়, এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের দিন। এই দিনে নতুন বছরকে আহ্বান করার পাশাপাশি নিজেকে নতুন করে চেনা, সমাজের সঙ্গে আত্মিক যোগ তৈরি করাও জরুরি। আমাদের প্রয়োজন একটি চলমান বাঙালিয়ানা, যা শুধুমাত্র ১৪ এপ্রিলের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের প্রতিটি দিনকে ছুঁয়ে যাবে।

শুধু উৎসবের বাঙালি নয় আত্মিক বাঙালি হতে হলে- আমাদের সাবধান হতে হবে। বাঙালি মনকে আরও শাণিত করতে হবে, মনের ভেতরকার জং মুছে ফেলতে হবে; আরও গভীর থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। আমি বাঙালি, এটা ভেতরে লালন করতে হবে। নিজেদের পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি জোগাতে হবে। গুরুসদয় দত্ত তার গানে বলেছিলেন, ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ, বাঙালি হ, বাঙালি হ।’ অর্থাৎ সাহস জোগাতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে নিজের ভেতরে। কেবল বৈশাখে নয়, বাঙালি হয়ে যেতে হবে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। যেন স্মৃতি হাতড়ে না বলতে হয়, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে...। একদিন বাঙালি ছিলাম রে...।’

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট