Image description

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে, কারা তাতে অংশ নেবে এবং কতটা গ্রহণযোগ্য হবে- এসব প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর এখনো মেলেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন মতামত নতুন সংকট তৈরি করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুই ধরনের সম্ভাবনার কথা বলেছেন-কম সংস্কার হলে নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর ব্যাপক সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের জুনে হতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দিহান।

অন্যদিকে, বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ঘোর বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করছে, সরকার এই কৌশলের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেনাপ্রধান আশাবাদী হলেও মাঠের বাস্তবতা বলছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা সহসাই মিটবে না।

নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে-নির্বাচন কবে হবে? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুটি ভিন্ন সময়ের কথা বললেও, বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়নি। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলোর দাবি, বর্তমান প্রশাসনের অধীনে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। 

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকার চাইলে ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে পারে, তবে বিরোধী দলগুলোর আপত্তি থাকায় সেক্ষেত্রে ব্যাপক রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হতে পারে। ফলে, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকারকে অবশ্যই সব রাজনৈতিক পক্ষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই সরকার কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নয় এবং তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। 

এই অবস্থায় বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো বারবার দাবি তুলেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার ও পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মতে, বিদ্যমান প্রশাসন নিরপেক্ষতার শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ, ফলে জনগণের ভোটাধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন মডেল প্রস্তাব করেছে, যা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ থাকবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।

সরকারপক্ষ অবশ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী কাজ করছে এবং বিরোধীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারা দাবি করছে যে, সরকার নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কর্মকাণ্ডে পক্ষপাতিত্বের ছাপ স্পষ্ট, যা জনগণের আস্থাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। 

অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমে গেলে নির্বাচনকালীন সময় আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা ক্রমশ বেড়ে গেলে সংঘাতের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ যদি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও গভীর হবে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন আয়োজনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো-দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা। কিন্তু বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা, দলীয় কোন্দল, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক চাপ, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন এসব বিষয় নির্বাচন আয়োজনকে কঠিন করে তুলেছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।” তার এই বক্তব্য অমূলক নয়, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত আরও বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে দিতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির কৌশলগত দ্বন্দ্ব এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে, যা বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নতুন ধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই মতপার্থক্য আরও প্রকট হয়ে উঠছে। বিএনপি চায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হোক। 

তাদের যুক্তি, সরকার স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনকে আড়াল করার চেষ্টা করছে এবং জনগণের দৃষ্টি বিভ্রান্ত করতে চাইছে। তারা মনে করছে, এতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার আরও বেশি সুযোগ পাবে এবং জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে না।

অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে এবং তারা মনে করছে, এই নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তাদের মতে, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ছোট ছোট নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারবে এবং মাঠ পর্যায়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে। 

জামায়াত ও এনসিপি মনে করে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাই দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এই কৌশলগত মতপার্থক্যের ফলে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐক্যে বড় ধরনের ফাটল ধরতে পারে। বিএনপি যদি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে, কিন্তু জামায়াত বা এনসিপি অংশগ্রহণ করে, তাহলে বিরোধী জোট আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ক্ষমতাসীন দলের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হবে। এর ফলে বিএনপি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং তাদের ওপর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক চাপ আরও বাড়তে পারে।

একই সঙ্গে, জামায়াত ও এনসিপির এই অবস্থান তাদের জন্য নতুন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তারা যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে সরকার তাদের ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করছে, জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধী জোটের ঐক্য নষ্ট হবে এবং সরকারের জন্য প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে যাবে। 

এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, একদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা, অন্যদিকে নিজেদের জোটের ভেতরকার ঐক্য বজায় রাখা। জামায়াত ও এনসিপি যদি আলাদা কৌশল নিয়ে এগোয়, তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে, সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠবে, যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুবিধাজনক হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। 

এবারের নির্বাচনেও সেনাবাহিনী কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন, তিনি আশা করেন যে নির্বাচন হবে এবং তা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নির্ধারণে সরকার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেবে। যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে সেনাবাহিনী মোতায়েন হতে পারে। তবে সেনাবাহিনী যদি নির্বাচনে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়, তাহলে সেটি বিরোধী দলগুলোর জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে, কারণ তারা মনে করে, সেনাবাহিনী থাকলে নির্বাচন কিছুটা হলেও নিরপেক্ষ হতে পারে। 

রাজনৈতিক সমঝোতা কি সম্ভব? এই অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে একটি প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা সম্ভব কিনা। সরকার চাইছে, বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিক, তবে তাদের শর্তে। অন্যদিকে, বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল চাইছে, নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করা হোক। এই মতপার্থক্য দূর না হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে। বৈশ্বিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে সমঝোতায় পৌঁছায়, সেখানেই নির্বাচন বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। তাই বাংলাদেশেও একটি অন্তত মৌলিক সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক এবং নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে ধোঁয়াশা, এসব বিষয় সংকটকে আরও গভীর করছে। সরকার যদি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেয়, তাহলে বিরোধী দলগুলো তা মানবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। 

আবার ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। তাই সরকার, বিরোধী দল ও নির্বাচন কমিশনকে সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। তাই সময় এসেছে, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পথ খোঁজার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট