১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় জন্ম নেয় বাংলাদেশ। নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ঢাকায় ফিরে আসার পর সরকার প্রধান হলেন। অনেক সমালোচকদের মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনা হতাশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। যারা নিছক চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন না, বরং উৎসাহী ছিলেন জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে দায়িত্বসহ অংশ নিতে। তবে এ ধরনের সমালোচনা ভাসা ভাসা এবং অযৌক্তিক। বরং বলা যেতে পারে ক্ষমতায় যেতে না পারার মনোবেদনার প্রতিচ্ছায়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস এবং অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন যে শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল তা নয়, তারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং অন্যান্য সমাজবিরোধী কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’। ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশবলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল মাত্র ৭৫২ জন। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সার্বিকভাবে এসব তথ্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক সমালোচনা, অনেক কষ্ট অনেক ব্যথা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের প্রধান সেসময় খুবই ব্যস্ত। কিন্তু অর্থনৈতিক ভিত বলতে তখন কিছুই নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের যাতায়াতকে বিপর্যস্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সড়ক, ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছু ছিল না। শিল্পের উৎপাদন কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র। সার্বিকভাবে বলা যায় সংকটে ভরা চারদিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের যা হয়। কিন্তু তার মধ্যেও সংকট দাঁড়িয়েছিল অন্যখানে সেটা হলো ক্ষমতাসীন দলের আর্থিক অবস্থা পুরোটাই ছিল অসংযত। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ভাটা পড়ে ক্ষমতাসীন দলীয় কর্মীদের আচার-আচরণে। সেসময়ের যে অবস্থা সবাই হাতিসম্বল মানুষ কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পরে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা যে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত হলো পরিস্থিতি এমন হলো যা গণতান্ত্রিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতার পরিস্থিতি তৈরি করলো।
এ সময় শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করা হয়েছিল, যার ফলে শিল্প উৎপাদনের ৮৫ ভাগ চলে গিয়েছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে। ১৯৭২ সালে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টি না হওয়ায় খরাদাহ ভয়াবহ রূপ নেয়। খরাজনিত দুর্ভিক্ষ প্রবল অবস্থায় উপনীত হয়। এই খরাদাহ থেকে শুরু হওয়া দুর্ভিক্ষ সরকার তা মোকাবিলা করলেও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা থাকার কারণে বিশ্লেষকদের কাছে আওয়ামী লীগের সাফল্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা দূর করার জন্য প্রথম যে বিষয়টার দরকার ছিল তাহলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু তখনকার সময়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ছিল শেখ মুজিবের শাসনবিরোধী। রাজনীতি যদি বিরুদ্ধে থাকে তাহলে যেকোনো সরকারের বাহবা পাওয়া কখনো সম্ভব না। শেখ মুজিবের শাসনামলে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রয়োজন ছিল সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়। কিন্তু যেকোনো কারণে সেটা হয়নি। বরং স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। তখনকার সময় চীনপন্থি চরম বাম ও ডানপন্থি দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে যেসব প্রোগ্রাম দিচ্ছিল তা ছিল রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতিকে একদম অস্থিতিশীল করে তোলার মতো।
১৯৭২ সাল থেকে সরকারের যে অবস্থা তাতে রাস্তাঘাট-শিল্পকারখানা দাঁড় করানো যেমন জরুরি আবার জরুরি সরকারে স্থিতিশীল অবস্থা। কিন্তু সেসময় সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি ঘোষণা করল, বাংলাদেশ ভারতের অধীন এবং ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের’ জন্য পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়। আবদুল হক, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, দেবেন সিকদার, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সংগঠনও একই ধরনের আহ্বান জানায়। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি গোপনে সমর্থন লাভ করে ভুট্টোর এবং তারা ‘মুসলিম বাংলা’ স্থাপনের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার রক্ষীবাহিনী নামে নতুন একটি সশস্ত্র সংস্থা গঠন করল ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে।
আওয়ামী লীগের জনসমর্থন হারানোর অন্যতম কারণ হিসেবে রক্ষীবাহিনীর কথা উল্লেখ করা হয় এবং এখনো এই বাহিনী ও এর কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। এরপরেই ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য দ্রুত নির্বাচন ছিল রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর একটি বড় প্রচেষ্টা। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ২৯২টি আসনে। নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছিল এবং বিরোধী দল যদি ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দিতে পারত, তাহলে হয়তো কিছু আসনে জয়লাভও করত। কিন্তু তারা তা করেনি বরং অভিযোগ করল এই বলে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি। হলে আওয়ামী লীগ এত আসন পেত না। সব সমালোচনা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেতে থাকলো। সংবাদপত্র তখন কতোটা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পেরেছে জানি না। তবে এসব সংবাদপত্রে তখন এসেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের পরে মানুষের যে পরিমাণ আশা-আকাক্সক্ষা ছিল সেটা যে পূরণ হতে সময় লাগে মানুষ যে সময় অপেক্ষা করার চেয়ে অতিষ্ঠ ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অভাব-অনটনসহ বিভিন্ন কারণে।
রাষ্ট্র পুনর্গঠন সরকার করতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে দ্রব্যের সরবরাহ স্বাভাবিক করলে সমস্যা হয় বলে মনে হয় না। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের পত্রিকা দেখলে পরিষ্কার হয় যে পুরো পরিস্থিতি জনগণের আাশা-আকাক্সক্ষার বাইরে ছিল। একইসঙ্গে রাজনৈতিক সামাজিক অস্থিতিশীলতা মানুষকে আরো নিরাশ করছিল। তবে তখনকার পত্রিকায় যতোটা লেখা যেত তার পরবর্তী সরকার সাংবাদিকদের কলমকে অত সাবলীল রেখেছিল কিনা এটা ভেবে দেখার বিষয়।
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments