Image description

ইহা বাস্তব সত্য যে, দেশকে ভালোবাসা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি। আমরা এ সম্পর্কে সচেতন না থাকলেও এটা আমাদের হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত থাকে। দেশের অপমান, দেশবাসীর দুঃখ-দৈন্য, দেশের দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে, দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হলে, দেশকে নিয়ে কেউ উপহাস বা কটাক্ষ করলে এ অনুভূতি জেগে উঠে। 

যেমন ১৯৭১ সালে এ দেশের হাজার হাজার তরুণ গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল অকাতরে শত শত যুবক। ইহা সত্য দেশের মাটি ও মানুষের জন্য গভীর মমতা না থাকলে এটা কোনোদিন সম্ভব হতো না। মনীষী জ্যাকসন বলেছেন- ‘যে মায়ের সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তার মাতৃত্বের গৌরব চির ভাস্বর। দেশপ্রেম থাকা চাই বৈদেশিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য। ইতিহাস বারবার এটাই প্রমাণ করেছে যে একটা দেশপ্রেমিক জাতি শত্রুর কাছে কখনও পরাজিত হয় না। সে জাতির অন্তরে জ্বলতে থাকে দেশপ্রেমের আগুন অনির্বাণ শিখার ন্যায়। সারা পৃথিবীর মায়া মমতা, স্নেহ সব একত্রিত করলেও যেমন মায়ের অকৃত্রিম স্নেহের সঙ্গে তুলনা করা যায় না তেমনি সারা পৃথিবীর ঐশ্বর্য-বৈভব ও সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজ দেশের কোনো তুলনা হতে পারে না। 

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, দেশপ্রীতি ঈমানেরই অঙ্গ। মানুষ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই তার আপন জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারে। মহৎ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আলিঙ্গন করতে পারে মৃত্যুকে। কবি বলেছেন- ‘তুমি দেশকে যথার্থ ভালোবাস তার চরম পরীক্ষা, তুমি দেশের জন্য মরতে পার কি-না।’ এ দেশপ্রেম নিয়ে কোথায় যেন পড়েছিলাম। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না ‘দেশপ্রেম বাইরের কোনো প্রদর্শনীর বস্তু নয়, দেশপ্রেম মানুষের অন্তরস্থিত ভক্তি শ্রদ্ধায় গড়া। কবিতার কাব্যে, দেশকর্মী তার সমাজসেবায়, গায়ক তার গানে, শিল্পী তার ছবিতে, বৈজ্ঞানিক তার বিজ্ঞান চর্চায়, শিক্ষক তার একনিষ্ঠ শিক্ষকতায় দেশপ্রেমের পরিচয় প্রদান করতে পারেন।’ মনীষী ওয়ালেস রাইস বলেছেন- ‘বুদ্ধিজীবীর কাছে তার দেশ ও সেবিকার কাছে তার রোগীর একই ভূমিকা হওয়া উচিত। শুধু সংগ্রামী রূপ ধারণ করেই আবির্ভূত হয় না দেশপ্রেম। 

সত্যিকার দেশপ্রেম হচ্ছে দেশকে গড়ে তোলার সাধনা করা। দেশের সচেতন নাগরিকদের কারো অজানা নয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাটাই কঠিন। দেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলাটাই দেশবাসীর লক্ষ্য হওয়া উচিত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করে তোলাও দেশপ্রেমিকের পবিত্র দায়িত্ব।’ মনীষী জিপি হল্যান্ড এর ভাষায় যদি মৃত্যুহীন হতে চাও তবে তোমাকে সৎভাবে দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। 

এ কথাও সত্য যে, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কখনও সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেন না। নিজের দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা মানে অন্য দেশের প্রতি শত্রুতা নয়। কাজেই একজন দেশপ্রেমিককে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত রেখেই নিজের দেশকে ভালোবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রকৃত দেশপ্রেম নিজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বৃহৎ পৃথিবীর মাঝে নিজকে ছড়িয়ে দেয়। মনীষী ডি স্টায়েল এর বানী হচ্ছে- ‘অন্যের দেশকে যত বেশি করে দেখা যায়, নিজের দেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসাটা ততই বেড়ে যায়।’ মনীষী জর্জ রো-এর ভাষায় যে কখনো বিদেশ যায়নি সে কখনো দেশের মমত্ব বুঝতে পারে না। একজন সাংবাদিক ও লেখক হিসাবে, দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসা রয়েছে এমন একটা মনোভাবকে হৃদয়ে ধারণ করেই আমরা দেশে বসবাস করি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দেশের প্রতি আমাদের কোনো মমত্ববোধ আছে কি? আমরা কি দেশের উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি, সুনাম-দুর্নাম, শত্রু-মিত্র ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করি?

আজ হরতালের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, এমনকি অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কেউ বলছেন, হরতাল রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি উপায় ও কৌশল। গেল সপ্তাহে ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক পত্রিকায় একজন লেখকের লেখায় দেখলাম, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। আমি দ্বিমত পোষণ করে বলি-হরতাল উপনিবেশি জমানায় এবং বিদেশি শাসকদের বেলায় শক্তিশালী অস্ত্র ছিল। নিজের দেশের বেলায় বিশ্বায়নের যুগে ইহা পুরাতন ধ্যান-ধারণা। অরাজকতা জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রক্ত ক্ষরণের মাধ্যমে দেশের প্রচুর ক্ষতি করে। এ ক্ষতির বোঝা জাতিকে বহন করতে হয় রাজনৈতিক দলকে নয়। প্রতিটি মানববন্ধন, গণ-অনশন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যায়। আমার প্রশ্ন গণ-অনশন যদি প্রতিবাদের ভাষা হয়ে থাকে তাহলে দাবি আদায়ের নামে আমরা যে সম্পদ বিনষ্ট করি তাতে ক্ষতি হচ্ছে কার? এ সম্পদ কি কোনো ব্যক্তি বিশেষের বা রাজনৈতিক দলের? এ সম্পদ দেশের, সমগ্রজাতির।

অরাজকতা শুধু দেশের সম্পদ নয় অনেক সময় এতে একাধিক জীবনেরও অবসান ঘটে থাকে। এছাড়াও আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি যে, অরাজকতার লাভ-লোকসানের বর্ণনা করতে গিয়ে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ সমর্থন করছি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি করি না এবং কোনো উচ্চাভিলাষও আমার নেই। তবে আমি রাজনীতি সচেতন। এটা কারো অজানা নয় যে, বর্তমানে যারা সরকারি দলে তারা এক সময় বিরোধী দলে ছিলেন আর বর্তমান বিরোধী দল ছিলেন এক সময় সরকারি দলে। বর্তমান সরকারি দল ভবিষ্যতে হয়তো পুনরায় বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে পারে এবং বর্তমান বিরোধী দলকে জনগণ হয়তো আবার সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। তাই ক্ষয়-ক্ষতির বর্ণনা কোনো পক্ষ-বিপক্ষের হতে পারে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নিজের দেশের সম্পদ ক্ষতি না করা।

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে আন্দোলনের দৃশ্য নিজ চোখে নাই বা দেখলাম কিন্তু আমাদের এ সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হতে আমি দেখেছি। অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতরা অনুধাবন করতে না পারলেও, জ্ঞানপাপীরা বুঝেও না বুঝার ভান করলে, রাজনীতিবিদরা বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির গুরুত্ব প্রদান না করলেও, দেশের সচেতন নাগরিকরা বুঝতে পারে, যে রাজনৈতিক দলের এমন খামখেয়ালির জন্য জান ও মালের অপূরণীয় ক্ষতি ছাড়া দেশের কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ আর যানবাহন ভাঙচুর দেশেরই ক্ষতি হয়, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ পরম সত্যটি আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগণ তখনই অনুধাবন করতে পারবে যখন তারা সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, নিজের দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতে পারবে। মনীষী ব্রাউনিং বলেছেন, ‘একমাত্র নিজের দেশকেই অন্ধের মতো ভালোবাসা যায়।’ মনীষী ভার্জিল এর ভাষায়, ‘সে সবচেয়ে সুখী যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে’। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়- ‘দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না, আর দেশকে না জানলে ভালো করতে চাইলেও ভালো করা যায় না।’ 

আজকাল দেশকে ভালোবাসার প্রতি কাউকে উৎসাহিত অনুপ্রাণিত করতে দেখি না। রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দলের কথা বলেন। গুণকীর্তন করতে থাকেন তাদের দলনেতার স্কুল, কলেজে যদিও দেশপ্রেমের উপর ছাত্র-ছাত্রীদের রচনা লিখতে বলা হয় তা শুধু লেখার জন্য লেখা। গ্রোথিত হয় না। শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, দেশপ্রেম আমাদের কারো মনকে নাড়া দেয় না। দেশের প্রতি মমত্ববোধ আমাদের আবেগ-প্রবণ করে না। ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতি না করে নিজেদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা জরুরি। আমাদের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য বই পড়তে হবে। কবির ভাষায় বলতে গেলেÑ স্বদেশের উপকারে নেই যার মন কে বলে মানুষ তারে? পশু সেই জন।

দেশের উপকারে যিনি নিবেদিত প্রাণ তিনিই প্রকৃত মানুষ। পক্ষান্তরে দেশপ্রেমহীন আত্মকেন্দ্রিক যিনি, তিনি নিঃসন্দেহে অধমের সমান। সমাজ জীবনে প্রতিনিয়ত এহেন মূর্খের মতো বিবেকবর্জিত অমানুষ দেখতেন বলেই হয়তো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আমাদের পূর্বসূরি রাজনৈতিক নেতারা প্রথমে মানুষ হওয়ার কথাই বলতেন। কিন্তু সে আদর্শবান পুরুষ বা রাজনৈতিক নেতা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তাই তাদের মূল্যবান কথাগুলো স্মরণীয় ও বরণীয় বাণীতে পরিণত হয়েছে। আমরা সবাই নিজেদেরকে যতই লেখক, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বা সচেতন নাগরিক হিসাবে দাবি করি না কেন, আমাদের উচিত হবে আমাদের চিন্তা-চেতনায় সে সব ব্যক্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদেরকে স্মরণ করা।

দেশের সদা প্রহরী হচ্ছে দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদদের প্রথম এবং প্রধান শর্তই হলো দেশপ্রেম। আমাদের দেশে বিভিন্ন দলের অনেক রাজনীতিবিদরা মহত্ত্বর, বৃহত্তর কল্যাণ বোধ থেকে ভ্রষ্ট। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় স্বার্থই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। দেশের সকল রাজনীতিবিদকে কথায় ও কাজে সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক হতে হবে। রাজনীতিবিদদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের উপরেই এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি রাজনীতিকে ব্যবসা বা পেশা হিসাবে নয়, সেবা হিসাবে নিতে পারলেই দেশের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার অবসান হবে, দেশের মঙ্গলে দেশের সকল নাগরিকেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশকে প্রাণাধিক ভালোবাসতে হবে এবং শুধু ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, দেশসেবায় ব্রতী হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশপ্রেম নয় কোনো নিছক বিমূর্ত আদর্শ, নয় কতগুলো প্রাণহীন শব্দের সমাহার। আর তাই মনীষী এডইউন আরলড এর বাণীটির সুরে সুর মিলিয়ে এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মুখ থেকে সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারিত হোক- জীবনকে ভালোবাসি সত্য কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়। 
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি