Image description

নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার পর পরই বাম জোট প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। বাম জোটের হরতালটি হয়েছে বিএনপির জামায়াতের অবরোধের মাঝে। বাম জোটের ডাকা হরতালে বিএনপি জামায়াতের অবরোধ কিছুটা হলেও গতি পেল। ২৪-এর জানুয়ারিতে দেশের সাধারণ  নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটা পূর্ব ঘোষিত একটি বিষয়। আর নির্বাচনটা কি ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা বর্তমান সরকার এবং  নির্বাচন কমিশন অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন। দেশে সাধারণ নির্বাচন যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে না, এই মর্মে বাংলাদেশের সংবিধানটি বর্তমান সরকার সংশোধন করে নিয়েছে। তাই ঘোষিত তফসিল কোনো কাকতালীয় বিষয় বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না। যদি তাই না হয়ে থাকে  তাহলে কেন তফসিল ঘোষণার পর বামজোটের হরতাল ডাকতে হলো। তাছাড়া এই সময়টায় চলছিল বিএনপি জামায়াতের ডাকা অবরোধ। বাম জোট কি আশা করেছিলেন বিএনপি জামায়াতের হরতাল অবরোধে সরকার সংবিধান সংশোধন করে ফেলবে, এই ভেবে কি আগে কোনো কর্মসূচি নেয়নি। বামেরা কি বিএনপি জামায়াতের ওপর নির্ভর করে? যদি নাই করে তাহলে এই অবরোধে হরতাল ডাকত না।

বর্তমান সরকার স্বৈরাচার দখলবাজ বিএনপির ভাষায়, বামেরাও তাই বলে। বর্তমান সরকার অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা ধরে রেখেছে এটা ঠিক, তাদের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে প্রক্রিয়ায় বিএনপি জামায়াত জোট করছে তার সাথে কি বামেরা একমত? আশা করি এই প্রশ্নের উত্তরটা বামদের দেয়া উচিত। তবে পরিবর্তনের জন্য যারা জোট বেঁধেছে তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করাটা কি বাম জোটের মানায়? বাম জোটের নীতি আদর্শ আর বর্তমান সরকারকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য  আন্দোলন করছে তাদের নীতি আর্দশ কি এক? যদি এক না হয়ে থাকে তাহলে বাম জোটের হরতাল ডাকাটা কি যুক্তিসংগত হয়েছে। কারণ বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনকে বেগবান করাটা কোনো মতেই বাম আদর্শের প্লাটফরমের উচিত হবে না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে জামায়াত তো  এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে, বিএনপিও করেছে তখন কিভাবে বামেরা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল । তখন এক পর্যায়ে এসে ৫ দল, আট দল, সাতদল ও জামায়াত রাজপথে থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দালোন করেছে। এই প্রশ্নটার উত্তর হলো- এরশাদের পতন হলে তার ফসল জামায়াতের ঘরে যাবে না, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এরশাদবিরোধী আন্দালনটি হয়েছিল। ঐ আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে রাজনীতির ধরন কি হবে তার একটি রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়, সেই রূপরেখার নিরিখে আন্দোলনের প্রাপ্তিটা কোন মতেই জামায়াতের ঘরে যাবে না তা ধরে নেয়া হয়। এবং রাজনৈতিক তদান্তিন দৃশ্যপটের ব্যাখ্যায় বুঝা যায় যে তার ফসল জামায়াত পাবে না।

তবে বর্তমান আন্দোলনকে যদি বামজোট বেগবান করে আর শেখ হাসিনার সরকারকে পতন ঘটায় তাহলে যে রাজনৈতিক প্রাপ্তিটা হবে তা কোন মতেই বাম জোট পাবে না। পুরো ফসলটাই জামায়াত বিএনপির ঘরে উঠবে। কারণ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দৌড়াচ্ছেন,  একটি অবাধ নিরপেক্ষ  নির্বাচনের জন্য। এই নিরপেক্ষতার মানেই হচ্ছে, আমেরিকা চায় না হাসিনার সরকার আর ক্ষমতায় থাকুক। আমেরিকা সরকার ১৯৭১ সালে যাদেরকে সহায়তা করেছিল বাঙালি হত্যা করার জন্য। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটা যেন সৃষ্টি না হয় এই জন্য পাকিস্তানকে তারা সহায়তা করেছিল, আর এই সহায়তার জন্য মাকির্নিরা বাংলা জনপদে কিছু পাকিস্তানি দোসরের সৃষ্টি করে।  পাকিস্তানি দোসররাই হলো  স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর।  বর্তমান সরকারের আমলে মানুষ হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে এই রাজাকার আলবদরদের ফাঁসি হয়েছে। এই সব কারণে মার্কিনিরা চায় এই সরকারের পতন। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী মাকির্নিরাও মরিয়া হয়ে উঠেছে এই সরকারের পতনের জন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত  পিটার হাস  দৌড়ঝাঁপ করছিলেন দেশের অভ্যন্তরে কিছু ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। কিন্তু বর্তমান সরকার এই দৌড়ঝাঁপকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তাই তিনি শ্রীলঙ্কায় চলে গেছেন। শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি আমেরিকায় গিয়ে তার সরকাররের কাছে বাংলাদেশের অবস্থার স্পষ্ট ব্যাখ্যা করবেন। তারপর মাকির্নিরা সিদ্ধান্ত নেবে। এটা বাংলাদেশ, এদেশের নির্বাচন হবে আমেরিকার সিদ্ধান্তে এটা বাম ডান কারো ভাবা উচিত না।

ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটা গুরুতপূর্ণ দেশ। তাই ভূবাণিজ্যে বাংলাদেশের  কদর বেড়েছে সারা বিশ্বের দেশগুলোর কাছে। তাই সবাই বাংলাদেশের পাশে থাকতে চায়। মার্কিনিদের এহেন আচরণের পর বামেদের কি করা উচিত? বামেরা কি চায় সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটিতে বাংলাদেশ আবার পরিণত হোক। বাংলা ভাই হিযবুত তাহরীরদের মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলো গড়ে উঠুক? বামদের বর্তমান সরকার পতনের আন্দোলন মার্কিনিদের পক্ষেই যাচ্ছে। আর এ ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম করাটা কি  যৌক্তিক হবে? বামাদর্শিকদের এই কথাটা মনে রাখা দরকার যে, দৈবাৎ কোনো ঘটনায় জামায়াত বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে ক্ষমতাসীনদের রোষানলের প্রথম শিকার হবে শাহবাগীরা। আর শাহবাগ স্কোয়ারে রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডের আন্দোলনের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন বামেরাই। সুতরাং এই সরকারের পতন হলে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসবে এটাই স্বাভাবিক চিন্তা। এই স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নাই।

বর্তমান আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটায়নি এ কথাটাও সত্য। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর পরিবর্তন আনেনি। তবে বিএনপির মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পুনর্বাসন প্রকল্পটা হাতে নেয়নি।  আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক চর্চাটা অনেকটা ভোট ব্যাংক নিজেদের দখলে রাখার কৌশল। অপরদিকে বিএনপি তার শাসনামলে মৌলবাদ চর্চার জাল রাষ্ট্রব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে।  তাই বিষয়গুলো বামদের হিসাব নিকাশ করা উচিত। বামদের ভুলের কারণে স্বাধীন দেশে মৌলবাদী রাজনীতির বিস্তার।

১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে বামেরা মিলে যায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে। ন্যাপ সিবি আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট। তখন তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকেনি। এই না থাকাটা ছিল বড় ভুল।  আর ঐ সময় উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল না থাকায়। মাকির্নিদের প্রেসক্রিপশনে জন্ম নেয় জাসদ নামের রাজনৈতিক সংগঠনটির। ভুঁইফোঁড় জাসদ হয়ে যায় প্রধান বিরোধী শক্তি। আর বিরোধী দল হিসাবে আবির্ভূত হওয়া জাসদের কার্যক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে হঠকারী রাজনীতি। জাসদ  দলটিতে ঠাঁই পেয়েছিল  মধ্যম ও ছোট পর্যায়ের স্বাধীনতাবিরোধীরা। এই পাকিস্তানি আদর্শিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে গণবাহিনী। এই বাহিনীর তাণ্ডবে  তৈরি হয় দেশে চরম অস্থিতিশীলতা।  এই অস্থিতিশীলতার ঘোলা জলে মাকির্নিদের মদতে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। ঘটে যায় রাজনৈতিক  পটপরির্বতন। উত্থান হয় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির। যে ধারাটি রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো বহমান। তাই বামদের সঠিক রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ৭১-এর পরাজিত শক্তির উত্থান না হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই