
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিযোগ ও ভোগান্তির চিহ্ন প্রকাশ পাচ্ছে দেশের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মধ্যে। একদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা পদ্ধতি, পরিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের চরম ক্ষোভ, যা ইতিমধ্যে নানাভাবে সামনে আসছে, অভিভাবকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে। অন্যদিকে পুরো শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক দাবি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনসমূহ। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হয় শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত এবং গবেষণার ভিত্তিতে। কিন্তু সরকার অদৃশ্য এক প্রক্রিয়ায় নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে।
শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিযোগের বিষয়সমূহ : বিজ্ঞান শিক্ষার সংকোচন, পরীক্ষা না থাকা, মূল্যায়ন পদ্ধতি, নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত না করা।
বিজ্ঞান শিক্ষার সংকোচন: এই অভিযোগটি দেশের অধিকাংশ শিক্ষাবিদ বেশি করছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করে নাম মাত্র একটি বিজ্ঞান বই রাখা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণিতে এখন আর রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞানের আলাদা কোনো বই বা পরীক্ষা থাকবে না। এই তিনটি বইকে সমন্বিত করে একটি বই ও একটি পরীক্ষা হবে। এতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ বলা যায় যেখানে বিজ্ঞানবিহীন আগামী কল্পনা করা যায় না। সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার সংকোচন বড় ধরনের অজ্ঞতা।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি: নতুন এই শিক্ষাক্রমে বড় একটি ভালো দিক হচ্ছে, অতীতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রিক যে অসহনীয় চাপ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতো সেই চাপ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাচ্ছে। “শিক্ষা যখন প্রতিযোগিতা নির্ভর হয় তখন শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট আবদ্ধ থাকে। শিক্ষাকে প্রসারিত করতে হলে, শিক্ষাকে আধুনিক ও উচ্চতরভাবে সমৃদ্ধ করতে চাইলে। শিক্ষা থেকে প্রতিযোগিতা পদ্ধতি বাদ দিতে হবে, শিক্ষাকে সর্বজনীন ও একধারার পদ্ধতি করতে হবে।” কিন্তু এই শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতি অতীতের চেয়ে খুব কষ্টসাধ্য শিক্ষার্থীদের নিকট। শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন পদ্ধতির মুখোমুখি হয়ে আরো তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান করার পরিকল্পিত কোনো পদ্ধতি না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে মোবাইলের দিকে ঝুঁকছে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে মোবাইল আসক্তি বেড়ে যাবে। বলা যায় শিক্ষার্থীরা এখনো এই পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত নয়। শিক্ষকরাও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে পুরোপুরি প্রশিক্ষিত নয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের প্রাত্যহিক অ্যাসাইনমেন্ট পেপার ব্যয় অভিভাবকদের জন্য অসহনীয়।
নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক : অর্থাৎ নতুন শিক্ষাক্রমের প্রত্যেকটা স্তরে স্তরে বিতর্ক, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির বই হাতে পাওয়ার পর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে বইয়ের মান নিয়ে। পাঠ্য বইয়ে খুব নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্র কি ভালো মানের পাঠ্যপুস্তকও দিতে পারবে না?
শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখনো দেশের অধিকাংশ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবকাঠামোগতভাবে অনুন্নত। শিক্ষকদের বেতন, ভাতা খুবই সামান্য পরিমাণে দেওয়া হয়। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা থাকার ফলে, শিক্ষকগণ প্রাইভেট, কোচিং করাতে ব্যস্ত থাকেন। এতে শ্রেণি কক্ষে ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন না। অর্থাৎ শিক্ষকদের শিক্ষার পরিবেশ এখনো নিশ্চিত নয়। খণ্ডকালীন কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও পরিকল্পনা মাফিক প্রশিক্ষণ দিতে কৃপণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং কিংবা শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক পরিচর্যার জন্য আলাদা কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক নেই। রাষ্ট্র যদি শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপযোগী করে না গড়ে তোলে, তাহলে আদৌ কি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব হবে?
সুতারং সরকারের প্রতি অনুরোধসূচক আহ্বান থাকবে, শিক্ষাক্রম নিয়ে দেশের সমস্ত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, অভিভাবকদের পরামর্শ নিয়ে একটি নতুন, আধুনিক, বৈজ্ঞানিক ও একই ধারার শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
লেখক: কলামিস্ট
Comments