Image description

খেলাপি ঋণ নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারের আমলে খেলাপি ঋণ সমালোচনা কম হয়নি। ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ এই প্রবাদটি সত্য প্রমাণ করেছে-আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন, যার চিত্র ক্রমেই উঠে আসছে। তাদের শাসনামলে কমবেশি সব খাতেই অনিয়ম-দুঃশাসন ছিল। তবে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক খাত, খাতটি একেবারে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। 

ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনার আর্থিক চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ব্যাংক খাতের অবস্থা এমন হয়েছে, ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। এরই মধ্যে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ২০১১ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬ দশমিক ১২ শতাংশ, সেখানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১৩ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১০.৮১ শতাংশ। 

এ সময় আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনার কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংক তীব্র ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়া ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে এটি কমে ১০.৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুনে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যত্রতত্র দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কারণে নিজেদের বিপদের মুখে ফেলেছে কয়েকটি ব্যাংক। ঋণ আদায় আটকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র আর্থিক সংকট, যা তাদের মূলধনের স্থিতিশীলতাকেও নড়বড়ে করে তুলেছে। 

সময়মতো ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এসব ব্যাংকের কাঁধে এখন খেলাপির বোঝা এতটাই চেপে বসেছে, যেখানে নতুন পরিকল্পনায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। এমন লাজুক অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের ঋণের প্রকৃত অবস্থা বের করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্যই ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু সমস্যাও দেখা দেবে। 

সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। দলীয় প্রভাবের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কার্যক্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভের ঘাটতি, দেশি-বিদেশি পর্যায়ে ঋণের দায় বৃদ্ধি, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ হ্রাস; সর্বোপরি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়ায় এ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 

এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব না হলে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে হজম করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। 

রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। যত আইন করা হোক, কোনো লাভ নেই, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকগুলো যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি, ঠিক তখনই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ ইস্যুতে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে, যা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য আরও শাপেবর হয়ে উঠেছে। 

একইসঙ্গে বলেছে, ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের এ নতুন নিয়ম চলতি বছরের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। নতুন নিয়মে তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর সব ধরনের ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে। বর্তমানে এ সময়সীমা ছয় মাস। দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান করতে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করবে- এটাই প্রত্যাশা। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।