অবশেষে উদ্ভাবনের ৯ বছর পর আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ‘পরিবেশবান্ধব’ পাটের সোনালি ব্যাগের। পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাবে জলবায়ুর যে বিপজ্জনক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি তার পেছনে বড় দায় রয়েছে পলিথিনের। পলিথিন তৈরির ইথিলিন, পলিকার্বনেট, পলি প্রোপাইলিন ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ বা পলিমারের অণুগুলো পরস্পর এত সুষ্ঠু ও শক্তভাবে থাকে যে, সেখানে কোনো অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রবেশ করতে পারে না। তাই পলিথিন মাটির নিচে বা পানিতে শত শত বছর টিকে থাকে এবং বিষাক্ত বিষফেনোল নির্গত হয়। যা মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে দেয়। মোট কথা এটি কোনোভাবেই পরিবেশ থেকে দূরীভূত করা সম্ভব নয়।
সহজলভ্য এবং নিত্য ব্যবহার্য পলিথিন এখন মানুষের গলার কাঁটা। প্রায় দেড় যুগ আগে নিষিদ্ধ হলেও আজও পলিথিন আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার করার পর আশপাশে ফেলে দেই। এর ফলে আশপাশের খাল, নদী, ড্রেন পলিথিনে সয়লাব হয়ে যায়। এখন আমরা আন্তরিকভাবে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার করতে চাইছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পলিথিনের মতো সহজে বহনযোগ্য, হালকা এবং কার্যকরী কোনোকিছু ব্যাপকভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণেই প্রতিদিন বাজারে, বাড়িতে পলিথিন ব্যবহারের এই চিত্র। শহরের জলাবদ্ধতার পেছনেও অন্যতম দায়ী পলিথিন।
আমরা পলিথিন ব্যবহার করছি এটা ক্ষতিকর জেনেও। পলিথিন যদি পুড়িয়েও ধ্বংস করা হয় তাতেও পরিবেশের সাথে যে বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায় তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা একটি টেকসই পরিবেশ তৈরি করতে বদ্ধ-পরিকর। পলিথিন সে পথে একটি অন্যতম প্রধান বাধা। অধিকাংশ পলিথিন ব্যবহারের পর আশপাশে ফেলে দিতেই মানুষ অভ্যস্ত। আমাদের চারপাশে তাকালে আজ চোখে পরে পলিথিনের জঞ্জালের স্তূপ। বিশেষ করে নর্দমা, খাল, নদীর তীর, জমি ইত্যাদি।
২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানে বলা হয়, সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাক অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সংশোধিত ২০১০ সালের আইনের ৭(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তির কারণে পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি হলে সেই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক তা পরিশোধ করতে হবে এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা সত্ত্বেও পলিথিন কিন্তু উঠে যায়নি। মানুষ তা ব্যবহার করছে। এবং সত্যি কথা বলতে এখন এটি জনপ্রিয়ও।
পলিথিন বন্ধ করার কার্যকর উপায় হলো এর বিকল্প বাজারে নিয়ে আসা। মানুষ যখন বিকল্প হাতে পাবে তখন ক্রমেই পলিথিনে উৎসাহ হারাবে। তখনই কেবল পলিথিনের এই ধ্বংস বন্ধ হতে পারে। সুতরাং এর বিকল্প কি হতে পারে? আমরা পাটের যে চিরাচরিত ব্যবহার জানতাম তার চেয়ে আরও বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো পাটের তৈরি পলিথিন বা পাট থেকে তৈরি সোনালি ব্যাগ। এর আবিষ্কারক বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান।
সারা বিশ্বে আজ মাথাব্যথার কারণ হলো পলিথিন। বলা যায় আমাদের সভ্যতা ধ্বংসের পথে যাওয়ার পেছনে এটাকেও দায়ী করা হয়। পরিবেশবান্ধব এই পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ বর্তমান সভ্যতার এক মহাগুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। যদি এটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় তাহলে পৃথিবীকে পলিথিনমুক্ত করার পেছনে বিশাল অবদানও রাখা সম্ভব হবে। দেশের পাটশিল্প ও পরিবেশ রক্ষার সুবিধার্থে পাটের পলিথিন উৎপাদন করে একদিকে যেমন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব অন্যদিকে মানবজাতির বৃহৎ স্বার্থে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে।
সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের প্রকল্প নিলে ঢাকা শহরসহ সারাদেশ উপকৃত হবে। কারণ পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ পরিবেশবান্ধব, পচনশীল ও সহজলভ্য। এখন প্রয়োজন এটি বাজারে ক্ষতিকর পলিথিন এর জায়গা দখল করার মতো উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করা যাতে সহজেই সবাই এটি ব্যবহার করতে পারে। এর কাঁচামাল আমাদের দেশীয়। ফলে একদিকে এই সোনালি ব্যাগ রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।
এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক কিন্তু এখনও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাট থেকে উদ্ভাবিত এক ধরনের ব্যাগ হলো সোনালি ব্যাগ। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেবল বায়োপ্লাস্টিক যা প্লাস্টিক ব্যাগের চমৎকার বিকল্প। সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই হালকা কিন্তু টেকসই। অর্থাৎ এটি প্রচলিত ক্ষতিকারক পলিথিনের বিকল্প এবং ক্রমেই বাজার থেকে পলিথিনকে দূরীভূত করবে। এটি পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণের কোনো কারণ নেই কারণ এটি মাটির সাথে মিশে যাবে।
যেখানে পলিথিন কোনো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্মক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে ঠিক থাকে। অর্থাৎ পলিথিন পচতে বহু বহু বছর সময় লেগে যায়। পলিথিন দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর আকার এবং ব্যবহারযোগ্যতার কারণে। যদিও এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে কম-বেশি সবারই ধারণা রয়েছে। কিন্তু বিকল্প না থাকার কারণে পরিবেশে এর ক্ষতিকারক প্রভাব এতদিন ধরে ছড়িয়েছে।
জানা যায়, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। পরবর্তী সময়ও প্রকল্প নেয়া হয়। আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাবিত পর্যায়ে আছে। তবুও সোনালি ব্যাগ যুগে প্রবেশ করেনি বাংলাদেশ। এর উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে এবং কৃষকের কষ্টার্জিত উৎপাদিত পণ্যের নতুন এই ব্যবহার শুরু হওয়ার কারণে ভালো দামও পাবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সোনালি ব্যাগের ব্যবহার কয়েকটি দিকের সমাধান করতে পারে। প্রথমত, এর ব্যবহার শুরু হলে পলিথিনে আগ্রহ হারাবে মানুষ।
ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পলিথিন বাজার থেকে বিলুপ্ত হবে। এটি এমনভাবে ঘটবে যা অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সময়ের সাথে সাথে আজ বহু পণ্যই বাজারে নেই। কারণ তার চেয়ে ভালো বিকল্প বাজারে এসেছে। এটাই হবে সবচেয়ে বড় সফলতা। ধরিত্রীকে পলিথিনমুক্ত করতে পারলে এই অর্জন হবে গর্ব করার মতো বিষয়।
দ্বিতীয়ত, দেশে পাটের বাজার শক্তিশালী হবে। পাটের ভালো দাম পাওয়া নিশ্চিত হলে কৃষক পাট চাষে আগ্রহী হবেন। নানা কারণে আগের তুলনায় পাট চাষে আগ্রহ কমছে। দেশে পাটের নতুন ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হলে তা প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজন হবে। ফলে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে। পাটের ঐতিহ্য ফিরে আসার সাথে আমাদের অর্থনীতিরও যোগসূত্র রয়েছে।
তৃতীয়ত, পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগের বাজার বিদেশে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে তা অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে। নিজেদের আবিষ্কার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর ফলে নিজ দেশকে পলিথিনের পরিবেশ দূষণের বিষাক্ত হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি পৃথিবীকেও পলিথিনের দূষণমুক্ত করতে পারি।
পাটশিল্প এগিয়ে নিতে হলে পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর একটি সোনালি ব্যাগ। পলিথিনের চেয়ে দেড়গুণ বেশি শক্তিশালী হওয়ার কারণে তা হাতের নাগালে আসলে দ্রুতই মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হবে। এখন প্রয়োজন এর ব্যাপক উৎপাদন এবং তা বাজারজাতকরণ। বিপরীতে আগ্রহ হারাবে ক্ষতিকর পলিথিন। টেকসই পরিবেশ উন্নয়নে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হব।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments