
নির্বাচন সমাগত। সময় আছে মাস দুয়েক। গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি ভোট। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আগামী ৩০ নভেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র যাচাই করবেন ১-৪ ডিসেম্বর। যাচাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি হবে আগামী ৫-১৫ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ এবং আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর। প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। গত বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে বসে 'বাংলাদেশ বেতার' ও 'বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি)' জাতির উদ্দেশ্যে সরাসরি ভাষণের মাধ্যমে সিইসি এ তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচন তাহলে অনুষ্ঠিত হবে এটা পরিষ্কার করেছে নির্বাচন কমিশন।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কী ভাবে? তারা কে কোনদিকে? এসব হন্যে হয়ে খোঁজার একটি চেষ্টা আছে, সে বিষয় আলোচনাও আছে। কিন্তু কারা কি ভাবলো সেটা বিষয় নয়, বিষয় হলো বাংলাদেশ কী ভাবে। এবং সেটাই মূখ্য বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে আসছে কয়েক বছর ধরেই। এ ব্যাপারে ভারতও অনেক বিষয় যে ভাবছে না তা নয়। বিশেষত একটা বিষয় পরিষ্কার যে ভারতের আশপাশে তার বন্ধু রাষ্ট্র একমাত্র বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ- ভারত যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটা অভেদ্য। সুতরাং এখানের যে কোনো বিষয় নিয়ে তাকে ভাবতেই হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ বিষয় নিয়ে যেসব দেশের কূটনীতিকরা দৌড়ঝাঁপ করছে সেটা সবারই জানা। ইতিমধ্যে ভারত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে।
গত শুক্রবার ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের 'টু-প্লাস-টু' বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা। তিনি বলেছেন, একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই 'ভিশন'-কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। তিনি এটাও বলেছেন, 'বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেদেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।'
'টু প্লাস টু' বৈঠকের পর বিশেষ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক। সেখানে এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র সচিব ভিনয় কোয়াত্রা জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেদেশের মানুষ তাদের সংবিধান মতো নিজেদের ভবিষ্যত্ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ভারতের ম্যাসেজ পরিস্কার। আওয়ামী লীগ সরকারেরও এটাই চাওয়া, সংবিধান অনুযায়ি নির্বাচন। দেশের বিরোধীমতের বেশিরভাগ দল চায় দলীয় সরকারের নয়, নিরপেক্ষ বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বের তাগিদ সুষ্ঠু নির্বাচন। ভারতের সমান্তরালে চীনও চায় সংবিধানের আওতায় নির্বাচন।
এখন পিটার হাস এবং তার দেশ কী করে সেটা দেখার বিষয়। এর আগ পর্যন্ত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়েছে, তাদের নজর আছে সেদিকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও বাংলাদেশের নির্বাচনে নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিলো না। হরতাল-অবরোধ জ্বালাও- পোড়াওকে কেন্দ্র করে ধরপাকড়ের মাত্রা ও তীব্রতা নিয়ে ইইউ গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদেও অনেক সক্রিয়তা দেখালেও তার মধ্যে ঘোষনা হয়েছে নির্বাচনী তফশীল। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল এক প্রত্যাখ্যান করলেও নির্বাচন যথামসয়ে সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন তৈরি, এটাতো এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতার পেটানোর প্রকাশ্য হুমকিকে ‘অসহযোগিতামূলক আচরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল। সরকার এসব নিয়ে এখন আর ভাবছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো তারা খুব গুরুত্বের সাথে দেখছে জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, খুব কাছ থেকে দেখা হচ্ছে নির্বাচনী পরিবেশও। এমন একটি আভাস সরকারের কাছেও ছিল। অগ্নিসন্ত্রাসের ভিডিও বিদেশি কূটনীতিকদের দেখিয়েছে সরকার। তার প্রতিক্রিয়া একনো জানা যায়নি। অন্যদিকে এরইমধ্যে চীনেরও নির্বাচন সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার। অন্তত ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের ম্যাসেজ এমনই। আসন্ন নির্বাচনের পরে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে আশা করে তিনি বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচনের ইঙ্গিত করেছেন। সেইসঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, চীনা বিনিয়োগকারীদের পছন্দের জায়গা হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করে আরও বিনিয়োগের আশ্বাসও দেন। চীনের এমন ভূমিকা বাংলাদেশের প্রধানবিরোধীদল বিএনপির জন্য বড় কষ্টের ও পীড়ার। কারণ তারাই ছিল বিএনপির ঐতিহাসিক মিত্র। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতিও দিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মিতালির সূচনা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বিএনপির কিছু ভুলের সুযোগ নিয়ে সেই চীনকে আয়ত্ব করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই বেদনা এখন হজম করা ছাড়া গতিও নেই বিএনপির। দল থেকে চীনা রাষ্ট্রদূতের সেদিনের সরকারঘেঁষা বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে গত শনিবার। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আসন্ন নির্বাচন দেখতে চায় বলে চীনা রাষ্ট্রদূতের যে মন্তব্য, তা জনগণের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়।
একটি দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করতে তখনই সাহস পায় যখন দেশে গণতান্ত্রিক সংকট থাকে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গাজায় যে গণহত্যা চলছে তাতে কারা মদদ দিচ্ছে। ইসরাইল কাদের শক্তিতে শক্তিমান। বিশেষত এই গণহত্যার পেছনে কারা, সব জানা সত্ত্বেও আমাদের দেশের ব্যাপারে তাদের মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান সবার জানা।
তারপরও কথা হলো রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছুই নেই। যে কারণে আজ চীন-মার্কিন বলয়ের প্রশ্ন আসছে। গণমাধ্যমে আসা ভারতের ভূমিকা ও চীনের রাষ্ট্রদূতের ইঙ্গিতের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কী পদক্ষেপ নেয় তা অপেক্ষার বিষয়। কূটনীতি বোঝা ব্যক্তিদের কাছে মার্কিনি এসব মোলায়েম-নরম কথার অর্থ বড় কঠিন-গরম সেটাও সবার জানা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পরাশক্তি এখন শক্তের ভক্ত। সেই শক্ত-সামর্থ দেখানো অব্যাহত রাখলে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিমান আওয়ামী লীগ তথা সরকারের দিকেই আসবে। বিএনপির দিকে যাবে না। সেই বিশ্বাস থেকে বিরোধী শিবিরে বলপ্রয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনা বিএনপির ক্ষমতার আশাকে চুরমার করে দেবে।
বিদেশি দূতাবাসগুলো গভীর পর্যবেক্ষণের কথা বলে তারা কিভাবে কী দেখছে বা দেখবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগ বিএনপি যদি আলোচনার টেবিলে বসে সংকটের সমাধান করতে পারতো তাহলে কে কি করবে সেসব ভাবতে হতো না। বিএনপি একের পর এক যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে তাতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা কি রণে ভঙ্গ দেবে, না আলোচনায় বসবে। সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিএনপি নির্বাচন ভিত্তিক দল সুযোগ পেলে অনেকে যে নির্বাচন করবে না এমন কথা ভাবা যায় না। তবে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে যে বিদেশি একটা ফ্যাক্টর আছে সেটা স্পষ্ট হলেও পরবর্তী বিষয় কোনদিকে যাবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ বার বার সামনে আসেছে মার্কিন ভিসানীতি। এছাড়াও কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments