Image description

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক নড়বড়ে দশার মুখোমুখি, যেখানে একদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধীরগতিতে এগোচ্ছে, অন্যদিকে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি গুরুতর সংকটে পড়বে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৩% পর্যন্ত নেমে আসতে পারে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই ধীরগতির প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি, বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে; অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭০%-এর বেশি।

বিশ্বব্যাংকের "বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট" প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে। বিনিয়োগের এই বেহাল দশা এবং অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর।

দেশের শিল্পখাত বর্তমানে এক কঠিন সময় পার করছে। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান তিনটি শিল্প এলাকা – গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী এবং সাভার-ধামরাইয়ে – প্রায় ১০০টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানা বন্ধ হওয়ায় ৬০ হাজারের বেশি কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন।

অধিকাংশ কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, বর্তমান সরকারের আমলে যারা এসব কারখানায় বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের অনেকে কারাগারে, অনেকে পালিয়ে গেছেন বা গা-ঢাকা দিয়েছেন। নতুন করে কারখানা চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব এবং ক্রয়াদেশ কমে যাওয়াও উৎপাদন বন্ধের অন্যতম কারণ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেন, "শতাধিক কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় নতুন করে কয়েক লাখ লোক বেকার হয়েছেন। যারা কারখানা বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন, তাদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধাভোগী মানুষ। শাস্তি সুবিধাভোগীরা পাবে কিন্তু যারা এসব কারখানায় কাজ করেন, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না রাখা বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ না। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য।"

তিনি আরও মনে করেন, জাতীয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো এবং দেশীয় শিল্পকে উপেক্ষা করে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, "তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে কারখানা চালানো দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। জ্বালানি সংকটে ভুগছে বেশিরভাগ কারখানা। কারখানায় উৎপাদন কম হলে এর প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়বে।" 

তিনি আরও যোগ করেন যে, ২০১২-২০২২ দশকে বেসরকারি খাতে শক্তিশালী আর্থিক প্রবাহ থাকলেও, বর্তমানে এই প্রবাহ কমে আসায় বেসরকারি খাত ধুঁকছে। মালিকদের হাতে অর্থ নেই, কারখানায় উৎপাদন নেই, যার ফলস্বরূপ শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারা এবং অর্থনীতিতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, অনেক ব্যাংক এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে পারছে না, অন্যদিকে প্রায় ১৬% হারে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালানো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ।

পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরের ২৬ ব্লক থেকে জ্বালানি সুবিধা পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কোনো কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান এ বিষয়ে বলেন, "দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এ সময়ে কোনো কোম্পানিই নীতিগত নিশ্চয়তা ছাড়া নতুন কোনো চুক্তিতে যেতে চাইবে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসা।"

তৌফিক আরও উল্লেখ করেন, গত ১০ মাসে ২১ লাখ মানুষ, যাদের মধ্যে ১৮ লাখই নারী, কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। এদের ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জরুরি।

সরকারের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, বর্তমানে যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে, তার প্রত্যেকটি বিগত সরকারের আমলের দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফসল। তিনি মনে করেন, যারা বর্তমানে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন, তারা নির্বাচনের পর সরকারের নীতির ওপর নির্ভর করে ধীরে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি সতর্ক করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের অর্থনীতির অনেক ভুল নীতির মাশুল আগামী আরও কিছু সময় ধরে দিতে হবে।