Image description

পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য বাড়ছে ঈর্ষান্বিত হারে। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানিতে দারুণ সাফল্য এসেছে। এসব দেশে পোশাক রপ্তানিতে ইউরোপে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাক রপ্তানিতে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আবারও দারুণ গতি পেয়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি যতটা না দামে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণনির্ভর।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখন বিশ্বমানের। ক্রেতারা এখানে নির্ভরতার জায়গা খুঁজে পান। তিনি বলেন, মূল্য সংযোজিত পোশাক উৎপাদন, ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এবং শ্রমিক-উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আবারও শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে।

তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আগের বছর এই অঙ্ক ছিল মাত্র ২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ইইউ’র বাজারে মোট পোশাক আমদানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ (মূল্য অনুযায়ী), এবং পরিমাণে বেড়েছে ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ইউরোস্টাটের বরাতে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এসব তথ্য জানিয়েছে।

বিজিএমইএ বলছে, আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি যা বাংলাদেশের বাজার দখলের সক্ষমতা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বাজার শেয়ার কমার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান দখলে বাংলাদেশ সফল হয়েছে।

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র, দুই বাজারেই বাংলাদেশের অগ্রগতি: একদিকে ইউরোপে রপ্তানিতে দারুণ সাফল্য এসেছে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।

বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় একক গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। মোট রপ্তানির ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশই সেখানে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দা ও কিছু সুরক্ষাবাদী-নীতির মধ্যেও এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশি পোশাকশিল্পের টেকসই প্রতিযোগিতাশক্তির প্রমাণ দিচ্ছে।

ইউরোপে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি হয়েছে ১৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৮২ শতাংশ)। এই অঞ্চলের শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে জার্মানি (৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার), এরপর রয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও পোল্যান্ড। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা উল্লেখযোগ্য।

যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য বাজার: বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে, যুক্তরাজ্যেও রপ্তানি বেড়েছে, যদিও হার তুলনামূলকভাবে কম মাত্র ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। অন্যান্য বাজার যেমন- জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

চীন পিছিয়েছে, বাংলাদেশ এগিয়েছে: ইইউ’র বাজারে চলতি সময়ে চীনের রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৭ শতাংশ, যা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে নির্দেশ করে। তুরস্কের রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া ২১-২২ শতাংশ হারে বাড়লেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য কমছে। ২০১৮ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি, সেই ব্যবধান কমে এসেছে মাত্র দুই গুণে। বাংলাদেশের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এবং চীনের কমে ১৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে।

দামে সামান্য হ্রাস, পরিমাণে বড় অগ্রগতি: এই প্রবৃদ্ধি যতটা না দামে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণনির্ভর। ইইউ বাজারে ইউনিট দামে গড়ে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, অথচ পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ ক্রেতাদের চাহিদামতো সাশ্রয়ী দামে পণ্য সরবরাহ করছে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

সাফল্যের পেছনে রয়েছে একাধিক শক্ত ভিত: বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে একাধিক শক্ত ভিত। এগুলো হলো- উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন। পরিবেশবান্ধব কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি)। সামাজিক ও শ্রমিক নিরাপত্তায় অগ্রগতি। দ্রুত ডেলিভারি সক্ষমতা। ইইউতে জিএসপি সুবিধা তথা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার।

সামনের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: উদ্যোক্তারা বলছেন, চলতি বছরের বাকি সময়েও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবণতা বজায় থাকার আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে ক্রেতারা বিকল্প বাজার হিসেবে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন, ফলে নতুন কার্যাদেশ আসার সম্ভাবনাও বাড়ছে।

তবে প্রতিযোগিতা, শুল্কনীতি পরিবর্তন এবং ইউরোপের বাজারে চাহিদা কমার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের নীতি সহায়তা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি টেকসই করা সম্ভব। এজন্য নতুন বাজারে প্রবেশ ও পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি জরুরি। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এখন প্রয়োজন মান বজায় রেখে বহুমুখী বাজারে প্রবেশ এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কৌশলী হওয়া।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের ৯০০টির বেশি কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করছে, এরমধ্যে ২৫টির প্রধান বাজার আমেরিকা। চীন ও ভিয়েতনামের পর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, বাজার শেয়ার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাকের আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে।