Image description

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা উপকূল মাদক কারবারিদের জন্য 'সেফ জোন' বা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। গত ১০-১৫ বছর ধরে সমুদ্রপথে নিয়মিত মাদক আসছে এই অঞ্চলে, যা স্থানীয় মাদকসেবী ও পর্যটকদের কাছে বিক্রির পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চোলাই মদ, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবার সহজলভ্যতার পর সম্প্রতি এখানে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথেরও (আইস) সন্ধান মিলেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদক সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সোর্স পরিচয়ে নিয়মিত মাসোহারা তোলার অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে অভিযানের আগেই মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য চলে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকবিরোধী অভিযানে খুচরা বিক্রেতা বা বহনকারীরা গ্রেফতার হলেও দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণের কারণে তারা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, মাদকের মূল হোতা বা গডফাদাররা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, যা মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন রোধে প্রধান বাধা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২ জুলাই রাতে একই মৎস্য বন্দরের খাপড়াভাঙ্গা নদী থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ভারতীয় শাড়ী ও মাদকের একটি চালান জব্দ করার পর রহস্যজনকভাবে মাদক উধাও হয়ে জব্দ তালিকায় শুধু ১৮০০ পিস ভারতীয় শাড়ী দেখানো হয়। এ সময় নোয়াখালী, হাতিয়া ও বরগুনার পাঁচজনকে আটক করলেও ট্রলার মাঝি ও মালিককে কৌশলে নিরাপদ রাখা হয়। 

২০১৭ সালের ১ জুন পুলিশের অভিযানে আলীপুর মৎস্য বন্দর থেকে ফাতেমা আক্তার সানজিদা নামের এক নারীকে ৩৯৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতারের পর এক মাছ ধরা ট্রলার মাঝি ও এক প্রভাবশালী মৎস্য আড়তদারের নাম বেরিয়ে এলেও আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে গতানুগতিক তথ্য এসেছে। তদন্ত কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে ট্রলার মাঝি ও মৎস্য আড়তদারের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে গেছেন।

২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর ভোরে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬ পিস ইয়াবাসহ টেকনাফের ইব্রাহিম ও উখিয়ার রোহিঙ্গা আলমকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি প্রাইভেট কার, বিদেশি পিস্তল, গুলি, একাধিক স্মার্টফোন ও সিম জব্দ করা হয়। মামলার পর আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও রহস্যজনক কারণে গডফাদারদের নাম প্রকাশ পায়নি। আদালতের নির্দেশে একাধিকবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও কোনো সঠিক তথ্য মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, তদন্তকারীরা দায় বহনকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের সুবিধা গুছিয়েছেন।

২০১৯ সালের ১ নভেম্বর রাতে পুলিশের অভিযানে উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়নের নেওয়াপাড়া গ্রামের বনি আমিনের ঘরের চৌকির নিচে মাটি খুঁড়ে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও বনি আমিন পালিয়ে যায়। তবে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল মহিপুর ইউনিয়নের কমরপুর গ্রাম থেকে ৬৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ তাকে আটক করা হয়।

২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর কুয়াকাটার একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২০০ বোতল বিদেশি মদসহ দুই হোটেল কর্মচারীকে আটক করা হয়, যেখানে হোটেল মালিককে আড়ালে রাখা হয়েছিল। একই বছরের ২ মে উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া খাল থেকে একটি ট্রলার, ৬৫ হাজার পিস ইয়াবা, একটি মোটরসাইকেল ও নগদ ২ লাখ টাকাসহ চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। 

চলতি বছরের ৩ জুলাই জেলার কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চার মাদক ব্যবসায়ীকে ৮ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও ইয়াবাসহ আটক করা হয়। অভিযানের পর ৪ জুলাই রাতে কুয়াকাটা প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পটুয়াখালী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হামিমুর রশিদ ক্রিস্টাল মেথ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সূত্রগুলো আরও জানায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে উপজেলার দুটি থানার অধীনস্থ দুটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্থান থেকে স্বল্প পরিমাণ চোলাই মদ, ইয়াবা ও গাঁজাসহ শত শত বিক্রেতা ও সেবনকারীকে আটকের পর মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হলেও ২-৪ মাস কারাভোগের পর তারা বেরিয়ে এসে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কলাপাড়া উপজেলায় এক ছোট কাগজের প্যাকেট গাঁজা আনুমানিক ১০০-২০০ টাকায় এবং প্রকারভেদে প্রতি পিস ইয়াবা ২০০-৩০০ টাকায় খুচরা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ইয়াবা বহনের কাজে কোমলমতি শিশু ও নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাহমুদ হাসান বলেন, "মাদকের বিস্তার রোধে আমি থানার সকল অফিসারের সঙ্গে মিটিং করেছি। সোর্সদের ব্যাপারেও নতুন কৌশল অবলম্বন করব। যেখানেই মাদকের সন্ধান পাওয়া যাবে, আমাদের পুলিশ সেখানেই হাজির হবে।"

কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জুয়েল ইসলাম বলেন, "আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা মাদক ব্যবসায়ী ও ছিঁচকে চোরদের গ্রেফতার করছি। সোর্সদের বিষয়ে আমরা আরও সতর্কাবস্থা অবলম্বন করছি।"

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিষিদ্ধ মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন রোধে জড়িতদের নিয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি সংশোধনাগারে রেখে মনোচিকিৎসা প্রয়োজন। এছাড়া যুবসমাজকে রক্ষায় নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তথ্য জেনে সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।