Image description

‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ এই প্রবাদটি সত্য প্রমাণ করেছেন আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন, যার চিত্র ক্রমেই উঠে আসছে। তাদের শাসনামলে কমবেশি সব খাতেই অনিয়ম-দুঃশাসন ছিল। তবে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক খাত, খাতটি একেবারে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনার আর্থিক চিত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ব্যাংক খাতের অবস্থা এমন হয়েছে, ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। খাদের কিনারায় ৭ ব্যাংক এমন সংবাদও প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে।

গতকাল প্রকাশিত সংবাদসূত্রে জানা যায় ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যত্রতত্র দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কারণে নিজেদের বিপদের মুখে ফেলেছে কয়েকটি ব্যাংক। ঋণ আদায় আটকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র আর্থিক সংকট, যা তাদের মূলধনের স্থিতিশীলতাকেও নড়বড়ে করে তুলেছে। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি ৭টি ব্যাংক এই সমস্যায় ভুগছে বেশি। সময়মতো ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এসব ব্যাংকের কাঁধে এখন খেলাপির বোঝা এতটাই চেপে বসেছে, যেখানে নতুন পরিকল্পনায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যে এদের সবার খেলাপি ঋণের কোটা ৫৫ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশের মাইলফলক স্পর্শ করে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপির দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।

ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ৬৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা শতকরা ৫৬ দশমিক ১২ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি) খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে শুধু রেকর্ড সৃষ্টি করেনি, বরং পুরো ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের রেকর্ডও করেছে। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা এবং এর খেলাপির হার ৯৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।

এমন লাজুক অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের ঋণের প্রকৃত অবস্থা বের করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্যই ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু সমস্যাও দেখা দেবে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। দলীয় প্রভাবের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কার্যক্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভের ঘাটতি, দেশি-বিদেশি পর্যায়ে ঋণের দায় বৃদ্ধি, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ হ্রাস; সর্বোপরি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়ায় এ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়।

দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব না হলে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে হজম করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। যত আইন করা হোক, কোনো লাভ নেই, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকগুলো যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি, ঠিক তখনই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ ইস্যুতে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে, যা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য আরও শাপেবর হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে বলেছে, ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের এ নতুন নিয়ম চলতি বছরের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।

নতুন নিয়মে তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর সব ধরনের ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে। বর্তমানে এ সময়সীমা ছয় মাস। অর্থাৎ, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে এপ্রিল থেকে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে এখন ব্যাংকগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, যদি খেলাপি ঋণের পুরোপুরি তথ্য প্রকাশিত হয়, তবে গ্রাহকদের আস্থা আরও তলানিতে গিয়ে পৌঁছাবে। শুধু নতুন নিয়ম নয়Ñ ব্যাংক খাতে দুষ্ট চক্র ভেঙে ফেলতে এবং স্বচ্ছতা আনতে তাই একটি সুনির্দিষ্ট, সময়োপযোগী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহির আওতায় আনা সময়ের দাবি। স্বচ্ছতার স্বার্থে এ খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাও দরকার। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কার সময়ের দাবি। তাই দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান করতে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করবেÑ এটাই প্রত্যাশা। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।

মানবকণ্ঠ/আরআই