Image description

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) এসি রুমে বসেই মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটির শুধুমাত্র স্কার্ব মালামাল গোপনে বিক্রি করে লোপাট করা হয়েছে শত কোটি টাকা। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে এসব মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আর এসব কিছু করা হয়েছে কোল পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে। 

কোম্পানিটির প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান ও ঢাকা অফিসের পিএন্ডই চিফ মনিরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে কয়েকটি ধাপে। মাতারবাড়ি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্তদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিতে গেলেও তারা স্বাক্ষাৎ দেননি। কোম্পানির জুনিয়র এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আরিফুর রহমান মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ‘স্যারেরা অফিসেই আছেন। কিন্তু অ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়া তারা স্বাক্ষাৎ দেন না।’ এ সময় মানবকণ্ঠের এ প্রতিবেদক ভিজিটিং কার্ড দিলে তিনি রুমে কার্ড পৌঁছে দিয়ে এসে জানান, ‘স্বাক্ষাৎ হবে না, এমডি স্যারসহ সবাই ব্যস্ত আছেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দীর্ঘদিন যাবতই লুটপাট চলে আসছে। কোল পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইফুর রহমান ও ঢাকা অফিসের পিএন্ডই চিফ মনিরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ মদদে মাতারবাড়ি প্রকল্প থেকে তার, ক্যাবলসহ শত কোটি টাকার স্কার্ব মালামাল গোপনে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সরকারি মালামাল বিক্রির নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই তাদের নিজস্ব কোম্পানি ‘ইকবাল মেরিন’সহ কাছের লোকজনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব মালামাল কয়েক ধাপে সরিয়ে নেয়া হয়। শুধুমাত্র ইকবাল মেরিনই ১৫ কোটি টাকার মালামাল সরিয়ে নিয়েছে স্থানীয় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায়। এর আগেও তারা দুই কন্টেইনার মালামাল নিয়ে যায়, যার আনুমানিক মূল্য ৭ কোটি টাকা।

জানা গেছে, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সাথে চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের অব্যবহৃত পণ্য (ক্যাবল জাতীয় মেটাল ও তার) এবং অন্যান্য জিনিস কোল পাওয়ারের কাছেই হস্তান্তর করে। এ সুযোগের অপব্যবহার করে এমডি, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও ঢাকার পিএন্ডই চিফ কোনো দরপত্র ছাড়াই শত কোটি টাকার মালামাল গোপনে বিক্রি করে দিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে নির্বিঘ্নে এসব অনিয়ম করে গেছেন তারা। যে কারণে তারা সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ায় স্কার্ব মালামাল পাচার চক্রের সদস্যরা ধরা পড়তে শুরু করেছে। 

গত শনিবার এ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে পাচারের সময় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের তামার তার আটক করেছে নৌবাহিনী। এ কাজে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে সাতজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা হলেন- মহেশখালী মাতারবাড়ী মাইজপাড়া এলাকার ছবিরের ছেলে মাহমুদুল হক, চট্টগ্রাম ভাটিয়ারীর খাদিমপাড়ার এবাদুল হকের ছেলে নিজাম উদ্দিন, সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ সেলিম, ফেনী সোনাগাজীর চরগণেশ এলাকার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে জাকির হোসেন, পূর্ব সুধাপুর এলাকার জেবল হকের ছেলে নুরুল হক, ছাগলনাইয়ার নাঙ্গলমোড় এলাকার মো. ফারুক ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ এলাকার মো. কামরুল।

পাচার চক্র আটকের অভিযানে নেতৃত্ব দেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ছৈয়দ আহমেদ শাকিব। প্রকল্প এলাকা থেকে এসব সামগ্রী মিলেমিশে লুটপাট করা হচ্ছে, যা তিন কর্মকর্তা আঞ্জাম দেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন আটক ব্যক্তিরা। জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার দুপুরে নৌবাহিনীর একটি দল মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের চার নম্বর জেটিঘাটে অভিযান চালায়। এ সময় হাতেনাতে আটক করা হয় লুটের সামগ্রীসহ জড়িতদের।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছেন, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিভিন্ন সামগ্রী লুটপাট করছে। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবারও চারটি কনটেইনারে তামার তার পাচার করে চট্টগ্রামের ইকবাল মেরিন কোম্পানির কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের এ মালপত্র পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ও কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি আবুল কালাম আজাদ, প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ও সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলফাজ হোসেন।

এদিকে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে প্রকল্প পরিচালকসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে আছেন- সিপিজিসিবিএল নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিজাইন) কামরুল ইসলাম, সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলফাজ উদ্দিন ও ডিজিএম (ডেপুটেশন) মতিউর রহমান। 

দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুবেল আহমেদ এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।


মানবকণ্ঠ/এফআই