

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। রোগীতে ঠাসা আউটডোর বিভাগ। প্রতিটি চেম্বারের সামনে দীর্ঘ লাইন। কোনো একটি চেম্বার থেকে রোগী বের হলেই তাকে রীতিমতো ঘিরে ধরছেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা, যারা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নামে বেশি পরিচিত। রোগীদের বলছেন চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন বের করতে। প্রেসক্রিপশন বের করার সাথে সবাই মিলে ছবি তোলার হিড়িক। অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই কাজটি করছেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা।
প্রেসক্রিপশনে রোগীর বিশেষ করে নারী রোগী গোপনীয় তথ্যসহ নানা নির্দেশনা থাকে। অনেক সময় পারিবারিক তথ্যও থাকে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির চ্যাটিং গ্রুপসহ বিভিন্ন জায়গায় তা আপলোড করা হয়। রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারগুলোতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের এই দৌরাত্ম্য এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের কোথাও রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা তো দূরের কথা, চিকিৎসকদের উপহার দেয়ারও নিয়ম নেই। ওষুধ প্রশাসনের নীরবতায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক দেখানোর পরে বেরিয়ে আসা নাইমা বলেন, তারা (মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ) যেভাবে বারবার বলে না দেখিয়ে কোনো উপায় নাই। একজন কাগজ (প্রেসক্রিপশন) দেখতে চাইল। পরে দেখি আরও কয়েকজন মিলে ছবি তুলতে শুরু করেছে। হাসিনুর নামে আরেকজন বলেন, আমি প্রথমে মনে করেছিলাম তারা হাসপাতালের লোক। এজন্য প্রেসক্রিপশনটা ওদের হাতে দিলাম। পরে শুনি তারা হাসপাতালের কেউ না। ওষুধ কোম্পানির লোক।
এদিকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, ছবি তোলায় তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী তারা প্রেসক্রিশনের ছবি তুলে তাদের চ্যাটিং গ্রæপ বা উপরের কর্মকর্তাদের পাঠান। অফিসের বাধ্যবাধকতা থাকায় বাধ্য হয়েই তাদেরকে এসব কাজ করতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, কি করব ভাই, আমরাও তো চাকরি করি। চাকরি বাঁচানোর জন্য আমাদেরকে বাধ্য হয়ে এসব কাজ করতে হয়। প্রেসক্রিপশনের ছবি না পাঠালে অফিস থেকে ঝাড়ি খেতে হবে। আরেক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখল কি না সেটা যাচাই করতে এবং অফিসকে দেখাতেই আমাদের ছবি তুলে পাঠাতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, তারা (মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ) যেন হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে না পারে, রোগীদের হয়রানি না করতে পারে, এ জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
তিন আরও বলেন, একটা নিয়মও করে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে সপ্তাহে দুদিন ডাক্তারদের সাথে ভিজিট করার সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। রবিবার ও বুধবার ১টা থেকে তারা ভিজিট করতে পারবে। কিন্তু তারা প্রত্যেকদিন আসে। প্রত্যেকদিন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়, তারপরেও তারা ঢুকে পড়ে। আজও আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের ১০-১৫ জনের মোবাইল সিজ করে রেখেছি। এখন আমরা তো সারাক্ষণ ওদের পিছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। এটা শুধু আমাদের হাসপাতালেই না। সব হাসপাতালেই একই অবস্থা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেসক্রিশনের ছবি তোলার নামে এভাবে হয়রানি করা, তাদের গোপনীয়তা নষ্ট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোভের ফাঁদে পড়ে ডাক্তাররাও নিম্নমানের ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিচ্ছেন। এতে সবদিক থেকে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বিশ্বের কোথায়ও, আমি বলব, ডাক্তারদের ঘুষ দিয়ে প্রভাবিত করার নিয়ম নাই। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এই সিস্টেম নাই। শুধু আমাদের দেশেই এই সিস্টেম চালু আছে। ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের গিফট দেয়া, নগদ টাকা দেয়া, এমন কি বাড়ি-গাড়ি করে দেয়ারও খবর পাওয়া যায়। এতে করে যেটা হয় তা হচ্ছে ডাক্তার নিম্নমানের ওষুধ রোগীদেরকে লিখে দেয়। কারণ সেই কোম্পানির কাছ থেকে সে ঘুষ নিয়েছে। আবার যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই সেটাও লিখে দেয়। এতে রোগীরা আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবার নিম্নমানের ওষুধে তাদের রোগ ভালো হচ্ছে না।
ছবি তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, ছবি তোলার কথা কি আর বলব। এটা রীতিমতো হয়রানি। এতে রোগীর যে গোপনীয়তা সেটাও রক্ষা হয় না। বিশেষ করে গাইনি রোগীদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে, যা ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করেন। সেটার ছবি তুলে তারা উপর মহলসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। এতে রোগীদের প্রাইভেসি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এসব বিষয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। কিন্তু তারা এসব শুনেও না শোনার মতো করে থাকছে। কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অবিলম্বে এসব বন্ধ করা উচিৎ।
মানবকণ্ঠ/এআই