Image description

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পৌনে দুই মাস আগে গঠন করা হয়েছিল নির্বাচনকালীন সরকার। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর গঠিত ওই সরকারে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে মোট সদস্য ছিলেন ২৯ জন। ১০ জন ছিলেন উপদেষ্টা। সে সময় এটিকে বলা হচ্ছিল সর্বদলীয় সরকার। এরপর একই প্রক্রিয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সরকার গঠন করা হয়। ওইসব সরকারে যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আহ্বান করা হলেও দলটি সায় দেয়নি কোনোবারই। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ ভিসানীতি ঘোষণা করার পর নির্বাচনকালীন সরকারের আলোচনা নতুন মোড় নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও নয় আবার বর্তমান সরকার বহাল রেখে নির্বাচন সেটিও নয়-মাঝা-মাঝি একটি অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত করা, প্রধানমন্ত্রীকে নিষ্ক্রিয় রাখা, কর্তৃত্বহীন রাখা। আওয়ামী লীগের নেতারা অবশ্য বলছেন ২০১৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে পরিমাণ ছাড় দিয়েছিল সেটিই সর্বোচ্চ ছাড়। তার বাইরে আওয়ামী লীগ আর বেশি ছাড় দিতে পারবে না। সংবিধানের আলোকে আগের কাঠামোতেই এবারও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দল যদি আগ্রহী থাকে তাদেরকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া হতে পারে।

সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করবেন, তখন ছোট সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে কারা কারা থাকতে পারেন, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা তিনি দিয়েই দিয়েছেন। এর আগে গত ১৫ মে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্র অনুসরণ করে। তাই ব্রিটেনে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই করা হবে। এর মধ্যে আমরা এইটুকু উদারতা দেখাতে পারি, পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য যারা আছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে যে, নির্বাচনকালীন সময়ে তারা সরকারে আসতে চায়, আমরা রাজি আছি।

রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেকরা বলছেন, বড় দুটি দল আগ্রহী হলে সংবিধানের আলোকেই নতুন ফরমেটের নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে তার চেয়ার থেকে সরে আসতে হবে। নতুন এই ফরমেটটি ফলো করলে সরকারি কিংবা বিরোধী দল কারো মনেই কোনো সন্দেহ থাকবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে অনাস্থা ও হতাশার পরিস্থিতি অব্যাহত রাখলে জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং এর শক্তি আরও বিপর্যস্ত হবে। এর সুযোগ নেবে দেশ ও বিদেশের অশুভ শক্তি।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। একই সঙ্গে তিনি তার রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদীয় দলের নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে গেলে তার সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ বা প্রশাসন কর্মকর্তারা অন্য দলের মন্ত্রীর কথা শুনে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন, এটা বিশ্বাস করা খুবই দুষ্কর। তাই আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে (যেমন স্পিকার বা সংসদের বিরোধী দলের নেতা) নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন করে এই সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপির কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া বর্তমান সংবিধান মোতাবেক অবশ্যই সম্ভব। এতে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাসী সব মহলের আস্থা বাড়ানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

সংবিধানে শুরু থেকে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনের বিধান ছিল। সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। সকল বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ একটি ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় কেয়ারটেকার’ সরকার গঠন করেন, যার একমাত্র দায়িত্ব ছিল তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অধীনে ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হলেও তা বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো।

এরপর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়, যে সরকারের মূল কাজ একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। তবে ২০১১ সালে মে মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ওই ব্যবস্থাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ এখনও একই জায়গায় রয়ে গেছে। বর্তমান সংসদে বিএনপির যেহেতু কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, ফলে দলটিকে নির্বাচনকালীন সরকারে নিতে হলে সংবিধান অনুযায়ী তা কীভাবে সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, সংবিধান অনুয়ায়ী মন্ত্রিসভায় ১০ সদস্যের বিপরীতে একজনকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী (সংসদ সদস্য নন) করা যায়। সে অনুযায়ী সরকারে ২০ জন মন্ত্রী থাকলে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হতে পারেন। একই কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমও। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করা এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি কোনোভাবেই মানা হবে না। সংবিধানের ভেতরে থেকেই কোনো সমঝোতা হলে তাতে আওয়ামী লীগের আপত্তি থাকবে না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বরাবরের মতোই হবে নির্বাচনকালীন সরকার। আকারে ছোট হবে। তারা রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মধ্যে যে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে রাখা হবে।

তবে ক্ষমতাসীনদের এসব কথায় একেবারেই কান দিচ্ছে না বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে, এটিই তাদের অবস্থান।

এ বিষয়ে সংসদে প্রধানবিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমাদের যে সরকারব্যবস্থা, সেখানে ৯৯ শতাংশ ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী নিজে। বাকি সবাই মিলে এক শতাংশ। সেখানে কে কয়টা মন্ত্রণালয় পেল, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, সেখানে গিয়ে কারও পক্ষে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়, যতক্ষণ এই এককেন্দ্রিক ক্ষমতার পরিবর্তন না হয়।