
টিনশেড ঘরে দাঁড়িয়ে আছে ৬০ বছর
বধিরদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুল এখন নিজেই বধির
নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক

ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা হাঁসটাকে দেখে সাদা খাতায় পেন্সিল দিয়ে আঁকার চেষ্টা করছে সুমনা। এর আগে সে একটা পাখি এঁকেছে। চারবার চেষ্টা করার পর অবশেষে পাখি আঁকা হয়েছে তার। আর যে-ই না হলো, দৌড়ে মার কাছে নিয়ে গেল ড্রয়িং খাতাটি!
মা জাহানারা বাইরেই বসে আছেন বাকি মায়েদের সঙ্গে। ক্লাস চলাকালীন এখানেই বসে থাকেন। মাঝে মাঝে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসেন। এই কাজ অবশ্য তিনি একাই করেন না। বাকি মায়েরাও গিয়ে গিয়ে ক্লাসে তার ছেলেমেয়েদের দেখে আসেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়লেও আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো পুরোপুরি স্বাবলম্বী না তারা। এরা সবাই মূক ও বধির। কেউ কেউ আবার শুধু শুনতে বা বলতে পারে। তবে বেশিরভাগই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী। এই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশজুড়ে অনেক স্কুল থাকলেও মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তাদেরকে এই স্কুল থেকেই পরীক্ষা দিতে হয়। স্কুলের নাম ঢাকা সরকারি বধির হাই স্কুল।
ঢাকায় প্রথম মূক ও বধিরদের জন্য স্কুল: বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে ঢাকায় প্রথম মূক ও বধিরদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। ১৯৪০ সালে এই স্কুল কর্তৃক তৈরি হয়েছিল মূক ও বধির ক্লাব। পরবর্তীতে এই দুটোই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৬৩ সালে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য ইস্ট পাকিস্তান ডিফ-মিউট অ্যাসোসিয়েশন। স্বাধীনতার পর, এর নতুন নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয় মূক ও বধির সংস্থা’। ১৯৭৬ সালের পর আবার নাম বদলে রাখা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা বা বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ডিফ। এ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্প হলো, ‘ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুল’।
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঢাকার বিজয়নগরে যখন স্কুলটি যাত্রা শুরু করে তখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৭-৮ জন এবং এটি ছিল একটি নৈশ বিদ্যালয়। এরপর তা প্রাথমিক পর্যায়ে এবং বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুবিধা রয়েছে এখানে। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এখান থেকে। পাশের হার শতভাগ না হলেও শত ভাগের কাছাকাছিই থাকছে।
এ বছর ৪২ জন পরীক্ষা দিচ্ছে এখান থেকে। প্রতিবন্ধী বলে পরীক্ষার প্রশ্ন এবং মূল্যায়নে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাদের সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমেও নেই কোনো বৈষম্য। কেবল পরীক্ষায় তাদের সময় একটু বেশি দেয়া হয় এবং তাদের খাতা আলাদাভাবে রাখা হয়। এছাড়া, মূলধারার ছেলেমেয়েরা যে বই পড়ে, তারাও তাই পড়ে।
বছরে দুটো পরীক্ষা হয় তাদের, অর্ধবার্ষিকী ও বার্ষিকী। যে প্রশ্নগুলো আসবে পরীক্ষায় সেগুলোই শিক্ষকরা তাদের বারবার চর্চা করান। বাসায় গিয়েও সেগুলোই পড়ে। যেন পরীক্ষায় পাস নাম্বারটুকু আসতে পারে।
শিক্ষার্থীদের যত্নের অভাব : সন্তানদের পড়াতে এসে স্কুলের শিক্ষাদান পদ্ধতির দিকে আঙ্গুল তুলছেন অনেক অভিভাবক। সাংকেতিক ভাষা শেখানো হয় না বলে অভিযোগ তাদের। বেশিরভাগ শিক্ষকই বই দেখে দেখে লিখতে দেয়। আবার সাংকেতিক ভাষা না শেখানোর কারণে, বোঝার ক্ষেত্রে এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা দূরত্বও রয়ে যায়। শিক্ষকদের মধ্যে এ ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা না থাকলেও স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম চেষ্টা করেন সাংকেতিক ভাষাতেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। প্রশাসনিক কাজের ফাঁকে তিনি প্রায়ই বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে গিয়ে গিয়ে ক্লাসগুলো পরিদর্শন করেন। কারও কোনো অসুবিধা হলে, কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে বুঝিয়ে দেন। অভিভাবকরাও যেকোনো ছোটো বড় সমস্যায় যখন তখন প্রধান শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে পারেন। তারা আফসোস করে জানান, যদি অন্য শিক্ষকরাও হেড স্যারের মতো এত যত্ন নিতো বাচ্চাদের, তবে ওদের ভবিষ্যৎ আরেকটু ভালো হতো।
শিক্ষকের সংখ্যাও কম: এখানের শিক্ষকরা অবসরপ্রাপ্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না। স্কুলটি সরকারি হয়ে যাওয়ায় নিজেরাও নিয়োগ দিতে পারছে না শিক্ষক। বারো বছর আগেও যেখানে ২৭ জন শিক্ষক ছিল, সেখানে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ১২ জন। এরমধ্যে কেউ উপস্থিত না থাকলে একজন শিক্ষককেই একসঙ্গে অন্য ক্লাসগুলো নিতে হয়।
৫০ বছরেও হয়নি পুনঃসংস্কার: এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি), শারীরিক শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এসবের কোনো ক্লাস হয় না। কোনো সাইন্স ল্যাব বা কম্পিউটার ল্যাবও নেই। নামেমাত্র শিক্ষক আছেন যিনি মূলত বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজই করে থাকেন। সেই সঙ্গে স্কুলের নেই কোনো স্বাস্থ্যকর আর উন্নত পরিবেশ। এত পুরনো আর সবার পরিচিত একটি স্কুল হওয়ার পরও স্কুলটির অবকাঠামোর দিক দিয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। না আছে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর শৌচাগারের ব্যবস্থা, পাঠাগার, বিশ্রাম কক্ষ এমনকি হাত ধোয়ার বা বিশুদ্ধ পানিরও ব্যবস্থা নেই। শ্রেণিকক্ষগুলোর জানালার গ্রিলে মরিচা ধরা, দেয়ালের প্লাস্টার খুলে আসছে, পর্যাপ্ত ফ্যান নেই, শ্রেণিকক্ষ স্যাঁতস্যাঁতে আলো কম। গত ৫০ বছরেও স্কুলটির কোনো পুনঃসংস্কার হয়নি।
পঠন-পাঠনের মান নিয়ে প্রশ্ন: দশম শ্রেণির একজন আবাসিক ছাত্র দীপ্র। বাড়ি নেত্রকোণা। আগে পরীক্ষার সময় এসে এসে পরীক্ষা দিয়ে যেত। কিন্তু সামনে এসএসসি বলে, স্কুল, কোচিং (স্কুলের শিক্ষকরাই প্রাইভেট পড়ান) করতে হয় নিয়মিত। তাই হোস্টেলে উঠেছে সে। কিন্তু সেখানকার খাবার দাবার, পরিবেশ কিছুই ভালো লাগে না তার। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়, কান্নাকাটি করে। অর্থের অভাবে অনেকেই তাদের সন্তানকে এই স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু লেখাপড়ার মান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কোনোটিই পর্যাপ্ত নয়। তারপরও নিজেদের সন্তানদের একটুখানি ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এখানে ছুটে আসেন নিম্নবিত্তের পরিবারগুলো। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল বা একাডেমিতে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে বোর্ড পরীক্ষার সময়ে এখানে এসে ভর্তি করাচ্ছেন। কিন্তু যাদের সে সুযোগ সামর্থ্য নেই, তাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে এই জরাজীর্ণ আর স্যাঁতস্যাঁতে টিনশেডের ঘরগুলোর দিকেই।
বর্তমানে সেখানে ছাত্র সংখ্যা ১২০ জন। আবাসিক হোস্টেলে প্রতি ছাত্রের মাসিক বেতন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু এই খরচটুকুও অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব না। ঢাকার ভেতরে যারা আছেন, তারা কোনোমতে পারলেও, যারা দূরে থাকেন, তারা অনেকে চাইলেও পারছে না ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াতে। এভাবেই সুযোগ ও সামর্থ্যরে যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নিম্ন আয়ের পরিবারের এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ।
মানবকণ্ঠ/এআই