Image description

রাজধানীবাসিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি বিলিয়ে ঢাকা মহানগরীর দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মো. আতিকুর ইসলাম। এরপর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির এক-তৃতীয়াংশেরও বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে পারেননি। যেগুলো শুরু করেছেন, সেগুলো থেকে কাক্সিক্ষত সফলতাও মিলছে না। নির্বাচনি ইশতেহারে দুই মেয়রই জলাবদ্ধতা, যানজট, মশার উপদ্রবসহ নানা সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি তারা। যে প্রক্রিয়ায় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলো সঠিক পদ্ধতি নয় বলেই নগরবাসী সুফল পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন বাস্তবতায় রাজধানীর প্রায় দুই কোটি বাসিন্দা যেন চেয়ে চেয়ে দেখছেন। দু-সিটির মেয়র কেউই কথা না রাখায় ক্ষোভ আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন ঢাকাবাসী।

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন হয় ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই প্রার্থী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মো. আতিকুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বিজয়ী হন। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের শপথ পাঠ করান। ডিএনসিসির মেয়র ১৩ মে দায়িত্ব নেন। ডিএসসিসির মেয়র দায়িত্ব নেন ১৬ মে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে ঢাকার দুই মেয়র যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার বেশির ভাগেরই বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই তাদের। রয়েছে এখতিয়ারবহির্ভূত প্রতিশ্রুতিও। এসব প্রতিশ্রুতি মূলত ভোটে জয়লাভের জন্য নগরবাসীকে প্রলুব্ধ করতে দেয়া। প্রতিশ্রুতি যে ওয়াদা এবং সেটা পালন করা আবশ্যক দুই মেয়রের কার্যক্রম দেখে তা মনে হয় না।

এদিকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করার নিয়ম থাকলেও একাধিক সংস্থার দ্বারা এলোমেলো ও সমন্বয়হীনভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি রাজধানীজুড়ে সাধারণ এবং নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাস্তার ধারে দোকানপাট ও হকারদের ব্যবসার কারণে রাজধানীজুড়ে ফুটপাতের জায়গা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও চলমান উন্নয়ন কাজের কারণে ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও গত তিন বছরে মেয়রদের কেউই হকারদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নিশ্চিত করতে পারেননি বা ফুটপাত থেকে সরাতে পারেননি। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কিছু সাফল্য দেখালেও চিরাচরিত সমস্যা থেকে মুক্তি পায়নি রাজধানীবাসী। নগর বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, অনেক ব্যর্থতার পাশাপাশি পুরান ঢাকার বাসিন্দারা এখনও তাদের আশপাশে মারাত্মক রাসায়নিক গুদাম নিয়ে বসবাস করছেন। নিমতলী ও চকবাজারের মর্মান্তিক ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বা গুদাম স্থানান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডসহ ঘটছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা।

ঢাকার দুই সিটি মেয়রের নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তার লিখিত বক্তৃতা ও তার ঘোষিত ৫ দফায় ৭০টি বিষয়ে উন্নয়ন, সংস্কার এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। এর মধ্যে মাত্র ১৫টি বিষয় নিয়ে বিগত সময়ে কাজ শুরু করতে পেরেছেন। সবগুলোর কাজও দৃশ্যমান নয়। গুটিকয়েক কাজের সুফল মিলছে। ডিএসসিসি মেয়রের স্লোগান ছিল ঐতিহ্য, সুন্দর, সচল, সুশাসিত ও উন্নত ঢাকা গড়ে তোলা। আর ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ত্রিমাত্রিক ইশতেহার ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি ৩৮টি প্রতিশ্রুতির দেন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও কম প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেছেন। সফলতার চিত্রও কম। তার স্লোগান ছিল সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়ে তোলা। দুই মেয়রের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, অসম্পন্ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাকি সময়ে তারা প্রচেষ্টা চালাবেন।

জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, মেয়ররা প্রতিশ্রুতি দেয়ার সময় তাদের এখতিয়ার, তফসিল ও ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে দেন। নগর বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন ছাড়া যেনতেনভাবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় তারা জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মেয়র প্রার্থীরা যখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন তাদের বলেছিলাম এসবের অর্ধেকই সক্ষমতা ও এখতিয়ারের বাইরে। বাকি মেয়াদকালের করণীয় সম্পর্কে ড. আদিল বলেন, সামনে দুই বছর সময় রয়েছে। এ সময়ে তারা কতটুকু পারবেন, তা বলা যাচ্ছে না।

ঢাকা উত্তর সিটি (ডিএনসিসি): প্রতিশ্রুতির মধ্যে যেসব বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি সেগুলো হচ্ছে ১. মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট (আইভিএম) গড়ে তোলা। আলোচনা হয়েছে, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ২. মিরপুরে ডিএনসিসির নিজস্ব জায়গায় বৃক্ষ ক্লিনিক ও পোষ্য প্রাণী ক্লিনিক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও কাজ শুরু হয়নি। ৩. প্রতিটি স্থাপনায় মাতৃদুগ্ধ কক্ষ স্থাপন করা হয়নি। ৪. প্রতিটি ওয়ার্ডে নানাবিধ নাগরিক সুবিধাসংবলিত ওয়ার্ড কমপ্লেক্স তৈরির কাজ কোনোটিতেই শুরু হয়নি। ৫. নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে বহুতল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং কমপ্লেক্স নির্মাণে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ৬. জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জনতার মুখোমুখি মেয়র’ শীর্ষক মতবিনিময়ের মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক সমস্যার সমাধান করার কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি-ডিএসসিসি: উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে যেসব বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি সেগুলো হচ্ছে- ১.দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়নি। ২. গণপরিবহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু সড়কে দ্রæতগতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীরগতির যানবাহন, আবার কিছু সড়কে শুধু হাঁটার ব্যবস্থা করার কাজের অগ্রগতি নেই। ৩. প্রয়োজনীয়সংখ্যক হাসপাতাল-ডিসপেনসারি ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনসহ মাতৃসদন নির্মাণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ৪. শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয়সংখ্যক কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ৫. মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধ করা এবং এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকর ও সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি। ৬. জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু করা হয়নি। ৭.সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ই-লাইব্রেরি চালু কাজের কোনো অগ্রগতি নেই।

অন্যদিকে রাজধানীর ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডে গাছ কাটা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গত ২১ মে দুপুর সাড়ে ১২টায় ডিএসসিসির নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের বাধার মুখে তিনি এমন মন্তব্য করেন।  এর আগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘বিক্ষুব্ধ পুরান ঢাকাবাসী’ ব্যানারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে।

এক বছরে ১০ বার বিদেশ সফর আতিকুলের: বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট পরিদর্শনে বর্তমানে চীন সফর করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। শুধু চীন সফরই নয়, গত এক বছরে অন্তত ১০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন ডিএনসিসির মেয়র। আর এ ভ্রমণে বিদেশে কাটিয়েছেন প্রায় ৭০ দিন।

ধাপে ধাপে নগরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছি- মেয়র আতিক: ‘সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে আমি বদ্ধপরিকর বলে মন্তব্য করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ধাপে ধাপে নগরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছি। কাজের মাধ্যমে মানুষের আস্থা-ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আমার প্রতি নগরের মানুষের অস্থা-বিশ্বাসই আমার কাজের শক্তি। আশা করি আগামী দুই বছরের মধ্যে আমার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারব।

দায়িত্বভার গ্রহণের পর জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি-তাপস: জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ১৩৬টি স্থাপনা নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি মন্তব্য করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস বলেন, বর্ষাকালে নগরবাসী ৩০ মিনিটের মধ্যে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে, যা তার মতে এক ঘণ্টা সময় লাগত। জলমগ্ন হয়ে পড়ত নগরীর প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। কিন্তু দায়িত্বভার গ্রহণের পর জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।

মানবকণ্ঠ/এআই