সমাজসেবায় মিলছে না সেবা
সহায়তা পেতে পাড়ি দিতে হয় কঠিন গিরিপথ!
ভিক্ষাবৃত্তি ঘিরে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের সিন্ডিকেট

- জাহাঙ্গীর কিরণ
- ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:২৪
হাসপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রম থেকে টাকা পাওয়া অনেকটা গিরিপথ পাড়ি দেয়ার মতোই দুর্গম। ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো জটিল রোগীদের প্যাকেজ সহায়তা কর্মসূচির কথা অনেকেরই জানা নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীপ্রতি ৫০ হাজার টাকার প্যাকেজ নির্ধারিত। কিন্তু এ টাকা পাওয়া অনেকটাই সোনার হাঁসের মতো দুর্লভ। মন্ত্রী, এমপি বা প্রভাবশালীদের সুপারিশ ছাড়া অনুদানের নাগাল পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। এছাড়া অনুদানের টাকা ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজাল তো আছেই। ফলে অনেক রোগী শেষ পর্যন্ত উপকার ভোগের আগেই হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। আবার কেউ কেউ সাহায্যের আশায় অপেক্ষা করতে করতে চিরবিদায় নেন।
এতো গেল একটি খাতের চিত্র। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিটি খাতই চলছে এভাবে। এ প্রতিষ্ঠানটির সেবাদানে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে ‘দারোগাগিরি’ ছড়ি। প্রকল্পে নয়ছয় তো আছেই। প্রতিষ্ঠানটিতে যাদের চাকরির বয়স যত বেশি, তাদের অনেকের সম্পদের পাহাড়ও তত বেশি। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের ঘুষের চরকিতে পা রেখে ঢাকা শহরে আলিশান বাড়ির মালিকও বনে গেছেন। বেছে নিয়েছেন বিলাসী জীবন। দীর্ঘ অনুসন্ধান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের শক্ত হাত পড়লে খবরের পেছনের খবর বের হতে বেশি সময় লাগবে না। এসব বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির বিষয়ে মহাপরিচালকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ভিক্ষুক পুনর্বাসনের টাকা যাচ্ছে কোথায়: প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছে ২ কোটি করে টাকা দেয়া আছে। তারা তাদের জেলা ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য এ টাকা ব্যয় করবেন। এ টাকা ব্যয় হয় ঠিকই কিন্তু ভিক্ষুকমুক্ত হয় না। তাহলে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের টাকা কোথায় যায়? এমন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে জনমনে। জানা গেছে, ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য টার্গেট নিয়েছিল সরকার। এজন্য নানা ধরনের প্রকল্প নেয়া হয়। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা কর্মসূচি তো রয়েছেই। নিরাপত্তা বেষ্টনীর বেশিরভাগ কর্মসূচিই প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় মানুষের সহায়তায় বাড়তি নজর দেয়ার কর্মসূচি। তাদের সহায়তা দেয়ার অংশ হিসেবে এই খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে চলতি বছর। এত টাকা ব্যয় করার পরও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে পারছে না সরকার। ভিক্ষুকের সংখ্যা তো কমছেই না বরং বাড়ছে দিন দিন। ভিক্ষাবৃত্তি ঘিরে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছরও সরকার এই খাতে ১ কোটি টাকার বাজেট বাড়িয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটির সভায় ভিক্ষুকদের জরিপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ ২০১১ সালে ভিক্ষুকদের জরিপ করা হয়েছে। সেই জরিপ অনুয়ায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হয় ১০ হাজার ভিক্ষুকের। এদের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত করা হয় ২ হাজার ভিক্ষুককে। এখন পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। অবশ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভাসমান ভিক্ষুকদের আটক করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হলেও পালিয়ে যান তারা। যে কারণে পুনর্বাসন প্রকল্প সফল করা যাচ্ছে না।
সংশোধনাগার যেন কারাগার: সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন টঙ্গীতে রয়েছে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। খাতা-কলমে প্রতিষ্ঠানটিকে শিশুদের জন্য সংশোধনাগার বলা হলেও বাস্তবে এটা একটা কারাগার। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভেতরের আবহ সেটিই বলে দিচ্ছে। দেখা যায়, মুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ শিশুদের একটি কক্ষে জড়ো করা হচ্ছে। সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষায় তটস্থ জহিরুল নামের এক ট্রেড ইন্সপেক্টর। অপেক্ষমাণ শিশুরা একটু এলোমেলো হলেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে সোজা করে দিচ্ছেন তিনি। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের আচরণে সংশোধন করার কোনো ধৈর্য বা আলামতের বালাই নেই। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া কয়েকজন কিশোর জানায়, একটি ঘরের মেঝেতে তাদের ২০ জন কিশোরকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে।
এতে করে তাদের রাতের ঘুম তো হারাম হয়েছে, উপরন্তু সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ছিল টয়লেটে যাওয়া। কেননা, ২০ জনের জন্য নির্ধারিত একটি মাত্র টয়লেট। ফলে ভোর রাত থেকেই এক রকম লাইন দিতে হয়। আবার পান থেকে চুন খসলেই নেমে আসে শাস্তির খরগ। সর্বনিম্ন শাস্তির নাম ‘নীল ডাউন’। এছাড়া ‘বড় ভাই’ নামের পুরনো বন্দিদের উৎপাত আছে সব সময়। যারা এখানে এক ধরনের মাস্তানি করে চলে।’
বকশিশ নামে চলে ঘুষ: সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা টু-পাইস কামাইয়ে সিদ্ধহস্ত। তবে তারা এটাকে ঘুষ বলতে নারাজ। তাদের ভাষায় বকশিশ। এটা নাকি জায়েজ। সবাই নেয়। কিন্তু কেউ ঘুষ বলে হৈচৈ করতে চাইলে তাকে সেবা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে। এমন চিত্র নিত্যদিনের। সরেজমিন সেবাদানের এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলে যে কারো কাছে এমনটিই মনে হবে।
সেবা সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নিবন্ধন পেতে বকশিশ বাণিজ্য অনেকটা ওপেন সিক্রেট। এমনকি বিনা মূল্যের ফরম বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। সম্প্রতি আজিমপুরে সমাজসেবার ঢাকা জেলা কার্যালয়ে গিয়ে এর প্রমাণও মেলে। পরিচয় গোপন করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ফরম চাইলে আলমারি খোলেন ডেসপাচ শাখার একজন কর্মচারী। ফরম দিয়ে টাকা দাবি করেন তিনি। বিনামূল্যের ফরমে টাকা চাচ্ছেন কেন-এমন প্রশ্নে তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝড়ে।
দিবাযত্ন কেন্দ্র চলছে খুঁড়িয়ে: আজিমপুরে অবস্থিত সমাজসেবার দিবাযতœ কেন্দ্রটি চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সি অন্তত ৩০ জন শিশুকে রাখা হয়েছে একটি বড় হলরুমে। সবার দৃষ্টি টিভির পর্দায়। ইউটিউবে দেখানো হচ্ছে ‘মটু পাতলু’ কার্টুন। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কার্টুনই নাকি তাদের বেশির ভাগ সময় দেখতে হয়। এছাড়া বিনোদনের অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রের উপ-তত্ত্বাবধায়ক জানান, এখনই আরবি টিচার আসবে। তখন টিভিও বন্ধ হয়ে যাবে।


