শিগগিরই চার্জশিট

তদন্তের মোড় ঘোরাতে ‘চতুর’ বাবুলের নাটক!

পিবিআইকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা


  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:০০

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় অনেকটাই ফেঁসে গেছেন স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর এ মামলায় তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) নিবিড় তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পরকীয়ার জেরে পারিবারিক কলহে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন বাবুল। খুনিচক্রকে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিলিং মিশন সফল করা হয়। অকাট্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মিতু হত্যায় তার স্বামী বাবুলসহ সাত আসামির বির’দ্ধে শিগগিরই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করতে যাচ্ছে পিবিআই। এমন পরিস্থিতিতে তদন্তের মোড় ভিন্নখাতে প্রবাহিত, চার্জশিটকে প্রশ্নবিদ্ধ ও কালক্ষেপন করতে পিবিআই প্রধানসহ দায়িত্বশীল ছয় কর্মকর্তার বির’দ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে। স্ত্রী হত্যায় সর্বোচ্চ সাজা থেকে রক্ষা পেতে ও কুচক্রী মহলের পরামর্শে বাবুল এমন নতুন নাটক করছেন বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, স্ত্রী হত্যামামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পিবিআই প্রধানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা সাবেক এসপি বাবুল আক্তার অত্যন্ত চতুর মানুষ। তিনি কখন কী বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে বাবুল যেসব কথা বলেছেন, তা বাস্তবসম্মত কি না, তা তদন্ত করেই বের করা হবে। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কেন সে (বাবুল) কথা বলছে? মন্ত্রী বলেন, তদন্ত সংস্থা পিবিআই ও টিমের উপর আমাদের ভরসা রয়েছে। ৩০ বছর আগের খুনের মামলার আসামিকেও তারা চিহ্নিত করেছেন। কাজেই আমি মনে করি, পিবিআই ভুল করবে না।

পিবিআই হেফাজতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দাবি করে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ও দুই এসপিসহ পিবিআইয়ের ছয়জন কর্মকর্তার বির’দ্ধে মামলার আবেদন করেছেন বাবুল আক্তার। শুনানি দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ১৯ সেপ্টম্বর। এ ছাড়া সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে ও পিবিআই প্রধানের বির’দ্ধে প্রতিহিংসার অভিযোগ এনে পুুলিশপ্রধানের কাছে গত মাসে আবেদন করেছে বাবুলের পরিবার। সব মিলিয়ে মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শেষে মোড় ঘোড়াতে এমন অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

তারা মনে করেন, পিবিআই প্রধানসহ এতোজন দায়িত্বশীল র্কমকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোন বিরোধ থাকতে পারে না। তদন্তে স্ত্রী হত্যায় প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা মেলার কারণেই সাবেক উদ্ধর্তন পুলিশ কর্মকতা হলেও বাবুলকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগে তার মামলার যৌক্তিকতা না থাকায় ১৯ তারিখে খারিজ হয়ে যেতে পারে। জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আসামিপক্ষ সবসময় সুবিধা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। মিতু হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও তেমনই চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে তদন্ত কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। তদন্ত শেষে চার্জশিট দেয়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মিতু হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বাকি ছয় আসামি হলেন-মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু ও শাহজাহান মিয়া। খুব দ্রæতই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একই সূত্র মতে, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুনের জন্য বাবুল আক্তার ৩ লাখ টাকায় খুনি ভাড়া করেন। এতে নেতৃত্ব দেন তার সোর্স মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু ও শাহজাহান মিয়া। বাবুলের পরিকল্পনা ও অর্থায়নেই মিতুকে খুন করা হয়েছে বলে চার্জশিটে বলা হচ্ছে।

পিবিআইয়ের একটি সূত্র জানায়, মাহমুদা ওরফে মিতু হত্যায় আর্থিক লেনদেনের অকাট্য প্রমাণ আছে। বাবুলকে জড়িয়ে এ পর্যন্ত আটজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাবুলের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ওইা ঘটনার পর একটি বই জব্দ করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, একজন নারীর কাছ থেকে বইটি উপহার পেয়েছিলেন বাবুল। বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠায় হাতের লেখাও ছিল। সেই উপহারের বইয়ে থাকা হাতের লেখা ও বাবুল আক্তারের হাতের লেখা পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে গুলি ও ছুরিকাঘাতে নিহত হন মিতু। এ ঘটনায় স্বামী তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। এক পর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম।

পরে গত বছরের ১২ মে বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে নতুন করে মামলা হয়। আদালতের নিদেশে মামলাটির তদন্তভার পায় পিবিআই। অধিকতর তদন্ত চলাকালে আদালতের আদেশে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ মামলায় বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। রিমান্ড শেষে প্রথমে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার কথা থাকলেও পরে জবানবন্দি দেননি বাবুল। তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যার সঙ্গে তার স্বামী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। সেদিনই চট্টগ্রামে আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় ৫৭৫ পৃষ্ঠার চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন পিবিআইর পরিদর্শক মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা। এরপর ওইদিনই পাঁচলাইশ থানায় মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন একটি হত্যা মামলা করেন। সর্বশেষ পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করেন।

মামলায় মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন উল্লেখ করেন, কক্সবাজার জেলায় চাকরি করার সময় বাবুল আক্তারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআরে ফিল্ড অফিসার (প্রোটেকশন) পদে কর্মরত ভারতীয় নারী গায়ত্রী অমর সিংয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার প্রতিবাদ করায় তার মেয়ে মিতুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত বাবুল আক্তার। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত ছিলেন বাবুল। তখন তার মোবাইল ফোন চট্টগ্রামের বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। ওই ফোনে গায়ত্রীর পাঠানো ২৯টি এসএমএস মিতু দেখে সেগুলো তার একটি খাতায় লিখে রেখেছিলেন।

এতে আরও বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের এক মাস আগে বাবুল চীনে এক প্রশিক্ষণে গেলে স্ত্রী মিতু দুটি বই পান, সেগুলো ওই নারী (গায়ত্রী) বাবুলকে দিয়েছিল। বই দুটির দুটি পাতায় গায়ত্রী ও বাবুলের লেখায় তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ মেলে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পারিবারিক অশান্তি চরমে পৌঁছেছিল। নির্যাতনের বিষয়টি মিতু তাকে (বাবাকে) জানিয়েছিল। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনেও এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar