খাদ্য সংকটে হাহাকার, প্রয়োজনের তুলনায় সহায়তা নগণ্য

সিলেটে চরম মানবিক বিপর্যয়

মুড়ি খেয়েই প্রাণ বাঁচাচ্ছেন সিলেটের বন্যা দুর্গতরা


  • প্রতিনিধি, দৈনিক মানবকণ্ঠ
  • ২০ জুন ২০২২, ১৫:১৮

কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছে সিলেটবাসী। বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি সিলেট নগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ ছিল পানির নিচে। গতকাল রবিবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি পানি কমেছে নগরীর আশপাশ এলাকায়ও। তবে সিলেটের অধিকাংশ এলাকা এখনও পানির নিচেই। খাদ্য সংকটে হাহাকার চলছে সবার মাঝে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এই সংকট আরও প্রকট। গত দুদিন ধরে মুড়ি খেয়েই দিন পার করছেন বন্যা দুর্গতরা। সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, শনিবার পর্যন্ত সিলেটের জন্য নগদ ৪২ লাখ টাকা, ৭ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৬১২ টন চাল দেয়া হয়েছেÑ যা এই বিপুলসংখ্যক দুর্গত মানুষের জন্য কেবল অপ্রতুল বললেও ভুল বলা হবে। তবে আশার কথা, পানি নামতে শুরু করায় কিছু কিছু দোকান খুলেছে গতকাল। বন্যা দুর্গতরা এসব দোকান থেকে চড়া দামে হলেও যৎসামান্য খাদ্যসামগ্রী নিতে পারছেন। সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগও চালু হয়েছে এরইমধ্যে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীতে ছোট যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। বড় যানবাহন পানি ডিঙিয়েই চলছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি। এছাড়া সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল সংযোগ নেই। বাড়িঘর আসবাবপত্র গবাদিপশু ফেলে রেখে জীবন নিয়ে কোনোমতে মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। সরকার নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সংকুলান না হওয়ায় উঁচু বিল্ডিং, হোটেল, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ এমনকি রাস্তাতেও আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। সর্বহারা এসব মানুষ খাদ্যের অভাবে দুর্বিষহ দিন পার করছে। গরিব থেকে ধনী সকলেই বন্যায় বিপর্যস্ত। কেউ কাউকে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনা খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে খাবারের জন্য হাহাকার করছেন বন্যার্তরা। জানা যায়, আশ্রয়কেন্দ্র মুড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। গত দুইদিন থেকে মানুষজন মুড়ি খেয়েই  আছেন। ছোট ছোট বাচ্চারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষরা ত্রাণের আশায় পথ চেয়ে থাকলেও অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি উদ্যোগে কোনো ত্রাণ এখন পর্যন্তও পৌঁছায়নি। বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কিছু এলাকায় শুকনো খাবার গেলেও পানিতে সয়লাব হওয়া যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

বানবাসীরা জানান, বন্যার কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ত্রাণ কার্যক্রমও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অনেকের ঘরে চাল-সবজি থাকলেও সেগুলো রান্না করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ ঘরবাড়িতে পানি উঠার কারণে আগুন জ্বালানের ন্যূনতম সুযোগও নেই। গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একাধিক বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, কোথাও কোথাও ঘরের চাল পর্যন্ত পানি উঠেছে। এ দুটি উপজেলার শতভাগ বাড়িঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অনেকে অনিরাপদ জেনেও বাড়ি ও গবাদিপশুর মায়ায় পানিবন্দি হয়েই দিন কাটাচ্ছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, অনেকের ঘরে কোমর থেকে গলাসমান পানি। ফলে জীবন বাঁচাতেই আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন তারা। তবে এখানে এসেও পড়েছে আরেক ভোগান্তিতে। স্থানের তুলনায় এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যা বেশি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার উপযোগী পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। এমনকি খাবারও পাচ্ছে না অনেকে।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে অসহায় মানুষের কাছে খুব একটা যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হওয়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। এছাড়া খাদ্যগুদামের আশপাশে পানি থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সেখান থেকেও খাদ্যসামগ্রী বের করা সম্ভব হচ্ছে না। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নৌকার সংকটে এসব ত্রাণ পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সর্বত্র ত্রাণ পাঠাতে চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, জেলায় মোট ৩৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০টি কেন্দ্রের আশ্রয়গ্রহণকারীদের তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে রয়েছে। সে হিসাবে ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ হাজার ৮৪৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বা পানীয় জলের তীব্র সংকট। নগরীতে আশ্রয় কেন্দ্র খুললেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

এদিকে গতকাল রবিবার সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি। এসময় সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, ‘এটা অভাবনীয় বিপর্যয়। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আমরা দুর্গত মানুষের সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। তবে বৈরী আবাহওয়া, প্রবল স্রোত, টানা বৃষ্টি, নেটওয়ার্কহীনতা সত্ত্বেও সেনা সদস্যরা বন্যা কবলিতদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।’ সেনাপ্রধান বলেন, ‘দ্রুত এই পানি নেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ সহসা কমবে না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হবে। পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা ত্রাণ ও চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছি। সেনা সদস্যদের বলেছি কষ্ট যতই হোক মানুষের দুর্ভোগে লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’

এদিকে প্রায় ১০ দিন পর সিলেটে বৃষ্টি থামায় নগরের পানিও কিছুটা কমেছে। আকাশ মেঘলা থাকলেও গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি আর হয়নি। এতে অনেকেই আশা করছেন, হয়তো দ্রুত কাটতে শুরু করবে ভয়াবহ এই দুর্যোগ। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে, তবে বেড়েছে কানাইঘাটে। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জানান, রবিবার কম পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা আমরা রেকর্ড করতে পারিনি। বৃষ্টির পরিমাণ নিম্ন পর্যায়ে থাকলে তা রেকর্ড করা সম্ভব হয় না। আজ সোমবার থেকে আকাশে মেঘের পরিমাণ কমে আসবে। বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক কমে যাবে। সেই সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি আরও জানান, আগামী ২৭-২৮ জুন বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এছাড়াও পুরো জুন মাস বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে  সিলেট রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম বলেন, রবিবার দুপুর থেকে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় শনিবার দুপুরে সিলেট রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল করে।

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar