সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প প্রণয়ন করায় হোঁচট খাচ্ছে প্রতিনিয়ত
নকশিপল্লীর কাজ ৩ বছরেও এগোয়নি ৩ শতাংশ!
মেয়াদের শেষপর্যায়ে এসে চলছে সম্ভাব্যতা যাচাই

- জাহাঙ্গীর কিরণ
- ১৮ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৩৪
হস্ত, কারু এবং তাঁত শিল্পের শ্রমিকদের আবাস ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রহণ করা হয় ‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লী’ প্রকল্পটি। কোনো ধরনের সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির পৃথক অফিসও নেয়া হয় রাজধানীর বিটিএমসি ভবনে। ব্যস, এই পর্যন্তই। অফিস ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা বাবদ নিয়মিত অর্থ ব্যয় হলেও গত তিন বছরে প্রকল্পটির কাজ এগোয়নি তিন শতাংশও। মেয়াদ যখন রয়েছে আর দুই মাস, তখন প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
বিলাসি ধাঁচে প্রণয়ন করা প্রকল্পটির বাস্তবায়নের এমন চিত্র দেখে যারপরনাই হতবাক এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কিভাবে গ্রহণ করা হলো আর কি করেই বা পুরো মেয়াদে বাস্তবায়ন কাজ স্তিমিত হয়ে রইল এর কোনো সদুত্তর মেলেনি কারও কাছেই। কমিটি প্রকল্পটির নতুন মেয়াদ নির্ধারণ করে অতিদ্রুত কাজ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবনে গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি মির্জা আজম। কমিটির সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, রণজিত কুমার রায়, মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং শাহীন আক্তার বৈঠকে অংশ নেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজেএমইএর চেয়ারম্যানসহ মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর ও শেরপুর জেলার হস্ত, কারু এবং তাঁত শিল্পের শ্রমিকদের আবাস ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে এই প্রকল্পের উদ্যোগ গৃহীত হয়। চলতি বছরের জুনে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হলে নকশি শিল্পে উদ্যোক্তার সংখ্যা ৩০০ থেকে বেড়ে ৯০০ জনে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিন লাখ থেকে কর্মসংস্থান ছয় লাখে উন্নীত হবে বলেও আশা করা হয়েছিল। একইসঙ্গে ১০ লাখ পণ্য থেকে নকশি পণ্যের উৎপাদন ৩০ লাখ হবে বলে ধরা হয়। অন্যদিকে দুই কোটি টাকা থেকে বেড়ে রপ্তানি আয় বছরে ১০ কোটি টাকায় উন্নীত করার কথাও ছিল প্রকল্প প্রস্তাবনায়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি, শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যের কথাও বলা হয়েছিল প্রকল্পের দলিলে। কিন্তু মেয়াদকাল ফুরিয়ে এলেও কোনো কাজই উতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। এখন মেয়াদকালের শেষ প্রান্তে এসে পুরো প্রকল্পটিই নতুনভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির পরিধি কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জমির পরিমাণ ঠিক করতে সম্ভাব্যতা জরিপ এবং আয়, ব্যয় ও লাভের সম্ভাবনা নির্ণয় করতে দেয়া হয়েছে।
এদিকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড প্রকল্পটির আগামী পরিকল্পনা সাজিয়েছে। তাঁত বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) গাজী মো. রেজাউল করিম জানান, প্রকল্পের আওতায় জামালপুর সদর ও শেরপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরপর প্রকল্পটি বাস্তবসম্মত সংশোধিত আকারে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সূত্রমতে, ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে কোনো প্রকল্প প্রণয়নের আগেই সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কোনো সম্ভাব্যতা জরিপ হয়নি। এখন প্রকল্পটির জন্য আদৌ ৩০০ একর জমির প্রয়োজন হবে কি না, তা জানতে প্রকল্পের অর্থায়নে সম্ভাব্যতা পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। তাছাড়া প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির হিসাব তুলে ধরতে অর্থনৈতিক ও হিসাব সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশের পরিপ্রক্ষিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টকে (এনএপিডি) প্রস্তাব দেয়া হলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা এনএপিডি একটি সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনা করে। সম্ভাব্যতা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রকল্পটির প্রস্তাবনা সংশোধন করা হচ্ছে বলে তাঁত বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, প্রকল্পটি প্রণয়নের সময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জমি ব্যবহারের প্রাক্কলন করা হয়েছিল বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উঠে এসেছিল। নকশি শিল্পের প্রায় ৩০০ শ্রমিক থাকলেও প্রকল্পে এক হাজার ১৮৪ পরিবার পুনর্বাসনের সংস্থান রাখার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় অতিরিক্ত শ্রমিকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সভায় জানান তাঁত বোর্ডের প্রতিনিধিরা। প্রায় এক হাজার ২০০ শ্রমিকের পুনর্বাসনেও ৩০০ একর জমির প্রয়োজন নেই বলে সভায় দাবি করে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা তখন জানান, একনেকে অনুমোদন পাওয়া শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী প্রকল্পে ১২০ একর জমিতে তাঁতি পরিবার পুনর্বাসনের উদ্যোগ রয়েছে। তাঁতপল্লী প্রকল্পে পাঁচতলা ভবনের সংস্থান থাকায় শ্রমিক থাকতে পারবেন বেশি। ওই সময় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে জমির স্বল্পতা রয়েছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নতুন প্রকল্পে জমির পরিমাণ আরো আলোচনা করে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্পটির আওতায় থিমপার্ক, লেকপার্ক, খেলার মাঠ, ডকইয়ার্ড, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্ফিথিয়েটার, সিটিং এরিয়া ও রেস্ট হাউজ নির্মাণের প্রস্তাবের সংস্থান রয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রকল্পটি নেয়া হচ্ছে দরিদ্র নকশি শিল্পীদের পুনর্বাসনে। এমন প্রকল্পের আওতায় এসব স্থাপনা নির্মাণ যৌক্তিক বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় পুনর্গঠিত প্রস্তাবে থিমপার্ক নির্মাণের যৌক্তিকতা আলাদাভাবে তুলে ধরার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য বিলাসি স্থাপনায় ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে সভায়।
এদিকে গতকালের বৈঠকে শেখ হাসিনা সোনালি আঁশ ভবন শীর্ষক প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং বিজেএমসির জনবল আত্মীকরণ নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া পাটজাত পণ্যকে কৃষি পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি, বেসরকারি পাটকলগুলোর ব্যাংক ঋণ মওকুফসহ পাটশিল্প খাতের সমস্যা নিরসনে মন্ত্রণালয় গৃহীত পদক্ষেপ এবং পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে অনুমোদিত শেখ হাসিনা সোনালি আঁশ ভবন প্রকল্পটি ডেভেলপার নিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের মাধ্যমে শেয়ারিং পদ্ধতিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মানবকণ্ঠ/এআই


