জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ১১২ জনকে পদোন্নতি
যুব উন্নয়নে অবাধ ঘুষ বাণিজ্য পদে জুনিয়র, টাকায় সিনিয়র!
মহাপরিচালক ও উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল

- জাহাঙ্গীর কিরণ
- ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৭
‘টাকায় সব হয়’ চিরাচরিত এই কথাটিই যেন সত্য প্রমাণিত করল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান যুব উন্নয়ন অধিদফতর। পদোন্নতির ক্ষেত্রে অবাধ ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। গ্রেডেশন তালিকা উপেক্ষা করে প্রতিযোগিতামূলক সর্বোচ্চ ঘুষদাতা ১১২ জন সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্বে বসানো হয়েছে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার পদে। অবসরে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর পরই এই অবৈধ নিয়োগের ঘটণা ঘটিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান। আর এই কাজে তার সহযোগী হয়ে কাজ করেছেন উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মোখলেছুর রহমান। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দেয়া এই নিয়োগের ফলে জুনিয়র কর্মকর্তারা সিনিয়র হয়ে বসে আছেন। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে চেন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে।
জাতীয় সংসদের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। কমিটি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। একইসঙ্গে জ্যেষ্ঠতা তালিকা লঙ্ঘন করে অর্থের বিনিময়ে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ৩য় শ্রেণির (১১ গ্রেড) ১১২ জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে চলতি দায়িত্ব প্রদান, বদলি বাণিজ্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে আগামী বৈঠকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবনে গত বুধবার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। কমিটির সদস্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, নাজমুল হাসান, মাহবুব আরা বেগম গিনি, আব্দুস সালাম মুর্শেদী এবং জাকিয়া তাবাসসুম বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভিন্ন সংস্থার প্রধানগণ ছাড়াও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর এক অফিসাদেশে ১১২ জন সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্বে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রায় সবাইকে নিয়মবহির্ভূতভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রতিযোগিতামূলক ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান ৭ নভেম্বর অবসরে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় এই অবৈধ নিয়োগের ঘটনা ঘটে। তবে মহাপরিচালকের পক্ষে উপ-পরিচালক (প্রশাসন) এই ঘুষ বাণিজ্য করেন এমনটিই চাউর হয়।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৭ সালে চালু হওয়া থানা সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্পের জনবলকে ২০০৫ সালে রাজস্ব খাতে নেয়া হয়। একই অধিদপ্তরের ১৯৯৫ সালের যুব প্রশিক্ষণ ও আত্ম-কর্মসংস্থান প্রকল্পের জনবল ২০১১ সালে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হয়। উভয় প্রকল্প থেকে আসা সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য ২০১৬ সালে জ্যেষ্ঠতার একটি খসড়া তালিকা করে অধিদপ্তর। আগে চাকরি স্থায়ী হওয়ায় থানা সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্পর ২৬১ জন জ্যেষ্ঠতার তালিকায় প্রথম দিকে স্থান পান। এই তালিকার বিরুদ্ধে যুব প্রশিক্ষণ ও আত্ম-কর্মসংস্থান প্রকল্পের লোকজন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে।
২০১৯ সালের জুনে মামলার রায় হয়। সেই রায় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে যুব অধিদপ্তর গত জুনে জ্যেষ্ঠতার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করে। এই তালিকার বিরুদ্ধেও যুব প্রশিক্ষণ ও আত্ম-কর্মসংস্থান প্রকল্পের লোকজন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করে। ট্রাইব্যুনাল এ তালিকার ওপর অস্থায়ী স্থিতাবস্থা জারি করে। অন্য পক্ষ গত সেপ্টেম্বরে ট্রাইব্যুনালে মামলা খারিজের আবেদন করে। উভয় আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত অক্টোবরে পদোন্নতির ওপর আরোপিত স্থিতাবস্থা বাতিল করে। এরপর যুব মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরকে পদোন্নতির একটি তালিকা পাঠাতে বলে। অধিদপ্তর তালিকা প্রেরণে কিছু সময় চাইলে মন্ত্রণালয় সময় বাড়িয়ে দেয়। এর ফাঁকে গত ২৫ নভেম্বর অধিদপ্তর ১১২ জন সহকারি উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব প্রদান করে।
সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, এর মধ্যে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় একদম নিচের দিকে থাকা কর্মকর্তাদের ‘পদোন্নতি’ দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, চলতি দায়িত্বের তালিকায় থাকা উল্লেখিত সহকারি যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতার ক্রমিক অনেক পেছনে। চলতি দায়িত্বের তালিকায় জ্যেষ্ঠতার তালিকা থেকে ১ ও ২ নং ক্রমিক ঠিক থাকলেও ১১২ জনের এ তালিকার ৩ নং ক্রমিক থেকেই জ্যেষ্ঠতার নিয়ম মানা হয়নি। জ্যেষ্ঠতার তালিকার ৪নং ব্যক্তি এসএম হাসান ইমামকে আনা হয়েছে ৩নং ক্রমিকে। প্রকৃতপক্ষে তার স্থলে ছিলেন ছালমান মিয়া। চলতি দায়িত্বের ৪নং ক্রমিকে আনা হয়েছে জ্যেষ্ঠতার তালিকার ৩৬১নং ব্যক্তি মো. খলিলুর রহমানকে।
এ তালিকায় জ্যেষ্ঠতার তালিকার ৩৮নং ক্রমিকের কামরুন নাহারকে ৫নং ক্রমিকে, ২৩নং ক্রমিকের মো. সাইফুর রহমানকে ৭নং ক্রমিকে, ১নং ক্রমিকের রকিব উল ইসলামকে ৮নং, ৪২নং ক্রমিকের নির্মল কান্তি মণ্ডলকে ৯নং, ৪৩নং ক্রমিকের মো. জহিরুল হককে ১০নং, ৪৬ নং ক্রমিকের মো. আমিনুল হক সরকারকে ১১ নং, ৪৯নং ক্রমিকের দীপক কুমার মণ্ডলকে ১২নং, ৫৭নং ক্রমিকের মো. রহমত উল্লাহকে ১৩নং, ৫৮নং ক্রমিকের প্রকাশ চন্দ্রকে ১৪নং, ৫৯নং ক্রমিকের আবুল কাশেম মো. ছাইফুল ইসলামকে ১৫নং এবং ৬০নং ক্রমিকের মো. হানিফ উদ্দিনকে ১৭নং ত্রমিকে নিয়ে আসা হয়েছে।
একইভাবে জ্যেষ্ঠতার তালিকার ক্রমিক ৬৯ কে ১৯, ৭২ কে ২০, ৭৮ কে ২২, ৮১ কে ২৩, ৮৪ কে ২৪, ৮৫ কে ২৫, ৯২ কে ২৬, ৯৫ কে ২৯, ৯৮ কে ৩০, ১০০ কে ৩১, ১০৩ কে ৩২, ১০৮ কে ৩৩, ১০৯ কে ৩৪, ১১১ কে ৩৪, ১১২ কে ৩৬, ১১৩ কে ৩৭, ১১৪ কে ৩৮, ১১৫ কে ৩৯, ১১৬ কে ৪০, ১১৭ কে ৪১, ১২২ কে ৪৩ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ৫৭ কে ১৩, ৫৮ কে ১৪, ৫৯ কে ১৫ করা হয়েছে। ৩৯২ কে করা হয়েছে ৭৬, ৫৫৮ কে ৮৮, ৭০৫ কে ৮৯, ৯৩৯ কে ১০৪, ৮৮৯ কে ১০১, ৮৩১ কে ১০৭, ৭০৩ কে ৯৩, ৭৩২ কে ৯৫, ৭৬৩ কে ৯৬, ২৬৫ কে ১১২ নং ক্রমিকে আনা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে করা এ তালিকায় ১২৬, ১২৭, ১৩২, ১৩৪, ১৪৫, ১৪২, ১৪৩, ১৪৪, ১৪৫, ১৪৯, ১৫০, ১৫৩, ১৫৮, ১৬০, ১৬৬, ১৬৭, ১৬৮, ১৭৫,১ ৮৬ নং ক্রমিকের ব্যক্তিদ্বয়কে চলতি দায়িত্ব দেয়া তালিকায় যথাক্রমে ৪৫-৬৯ নং ক্রমিকে সংযোজন করা হয়েছে। এভাবেই তৈরি করা হয়েছে ১১২ জনের ওই চলতি দায়িত্বের তালিকা।
এদিকে গতকালের বৈঠকে ২০১৪ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাতীয় যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত যুব ও যুব মহিলাদের বর্তমান অবস্থা; বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সার্বিক কার্যক্রম এবং বিগত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়। কমিটি বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন থেকে কুস্তি ফেডারেশনকে পৃথক করে অন্যত্র সরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।
বৈঠকে পূর্বাচলে প্রস্তাবিত শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম প্রস্তুতকালীন সময়ে সেখানে কোন কোন ফেডারেশনকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং ফেডারেশনের কি কি চাহিদা থাকতে পারে তা জানানোর সুপারিশ করা হয়। এসময় কমিটির পক্ষ থেকে সাউথ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম বারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জয় লাভ করায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সকল খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানানো হয়।
মানবকণ্ঠ/এআই


