সমবায় সমিতি অর্থ আত্মসাতের ভয়ানক ফাঁদ

- জাহাঙ্গীর কিরণ
- ১৪ মার্চ ২০২২, ১৫:৩৭, আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২২, ১৭:০৭
দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিপর্যয় প্রতিরোধ ও খাদ্যনিরাপত্তার বলয় সৃষ্টিতে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হচ্ছে সমবায়ী উদ্যোগ। কিন্তু আইনি দুর্বলতা, তদারকির অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসছে না খাতটি থেকে। উল্টো সাধারণ মানুষের কাছে এটি অর্থ আত্মসাতের ভয়ঙ্কর ফাঁদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেক মানুষ বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে টাকা জমা করে সর্বশান্ত হচ্ছেন। অথচ আইনি ত্রুটির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
জাতীয় সংসদের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে কমিটির সদস্যরা বলেন, বিশ্বের বহু দেশ সমবায় অঙ্গনে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে সমবায় সমিতিগুলো অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল এবং বিশ্ববাজারে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। অথচ স্বাধীনতার আগে যাত্রা শুরু করেও এদেশে সমবায় সমিতিগুলো মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না।
আইনি দুর্বলতার কারণে অনেকে টাকা আত্মসাৎ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা অতিদ্রুত সমবায় আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কমিটি সদস্য ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, স্বপন ভট্টাচার্য, মো. মসিউর রহমান রাঙ্গা, রেবেকা মমিন, রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, মো. শাহে আলম, মো. ছানোয়ার হোসেন এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদী বৈঠকে অংশ নেন।স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবসহ উর্ধ্বতন কর্মকতারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সমবায় সমিতিগুলো লক্ষ্য অর্জন না করার পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমবায় আইন। যথাযথ আইনি কাঠামো না থাকায় সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রকৃত সমবায়ীদের হাতে না গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সরকারি খাসজমি বা জলমহাল বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমবায়ীদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি পান না; সমাজের অনগ্রসর গোষ্ঠীর নামে বিভিন্ন ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা এ সুবিধা ভোগ করেন।
সমবায় আইনের নিবন্ধন সম্পর্কিত বিধানাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে এখানে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদি কোনো সমবায় সমিতি নিবন্ধনের জন্য সমবায় অধিদপ্তরে আবেদন করা হয় তাহলে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে আবেদনকারী ৩০ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে আপিল করতে পারেন এবং আপিল কর্মকর্তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে দেওয়ানি আদালতে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের অংশীদারি ব্যবসা আইন ১৯৩২ অনুযায়ী, যে অংশীদার তার অংশীদারি ফার্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক কোনো ব্যবসায় জড়িত থাকবে, তাকে ওই ব্যক্তিগত ব্যবসালব্ধ মুনাফা তার ফার্মের অংশীদারদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে। কিন্তু সমবায় সমিতি আইনে এ ধরনের কোনো বিধান নেই।
সমবায় সমিতি আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, সরকার গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা জনস্বার্থে কোনো সমবায় সমিতিকে কোনো বিধানের প্রয়োগ থেকে কোনো শর্ত সাপেক্ষে বা নিঃশর্তভাবে অব্যাহতি দিতে পারে। যদিও ধারাটি শুধু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়ার কথা, কিন্তু কার্যত এর যথেষ্ট অপব্যবহারের সুযোগ আছে। এ ধারার অপব্যবহার করে জনস্বার্থের নামে আইনের বিধানগুলো থেকে অব্যাহতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক সমবায় সমিতি চালানোর সুযোগ রয়েছে। এ কারণে অনেকে নিবন্ধন ছাড়াই কাজ করছে। আবার আইনের ত্রুটির কারণে অনেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যম হিসেবেও সমবায়কে বেছে নিচ্ছে।
এসব কারণে সমবায় আন্দোলন আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ করেনি এবং সমবায়ে সুশাসন দৃশ্যমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, এসব বিধান দ্রুত সংশোধন করা প্রয়োজন। এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া জরুরি। সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, নিরীক্ষা, বিরোধ নিষ্পত্তি, অবসায়ন, উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও দলীয়করণ এবং অসমবায়ীদের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করে আদর্শভিত্তিক সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠনে সমবায়ের কর্মকর্তারা দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেননি। তাই জনগণ সমবায়কে একটি অর্থবহ খাত হিসেবে মনে করে না এবং এ খাতে বিনিয়োগের আকর্ষণ বোধ করে না।
তারা বলছেন, বিদ্যমান আইনের মৌলিক সংস্কার ছাড়া সমবায় সমিতিগুলোর প্রকৃত সম্ভাবনা অর্জন সম্ভব নয়। একটি সমবায়বান্ধব আইনি কাঠামো সমবায়ীদের হস্তক্ষেপ কমাতে পারে, সমবায় সমিতির সদস্যদের তাদের সমিতির কার্যক্রমের প্রতি আরো উৎসাহী করে তুলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের নিষ্ক্রিয় সমবায় সমিতিগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে একজন সমবায় বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে এবং আরো দুজন অভিজ্ঞ সমবায় গবেষককে সদস্য করে কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কমিশন দেশের সমবায় সমিতির বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সমস্যা ও সম্ভাবনা নির্ণয় করে সরকারের কাছে করণীয় প্রস্তাব পেশ করবে। সমবায়ের বেহাত ও বেদখল হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া সমবায় অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সমবায়ীদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা কমিশনে পেশ করবে। কমিশন দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান সমবায় আইন বিধিমালা প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করতে পারবে। এটি করা হলে উন্নত দেশগুলোর মতো এই দেশেও সমবায় জৌলুস ছড়াতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সমবায় ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হলে এর দুর্বলতা ও অসামঞ্জস্যতা খুঁজে বের করতে হবে। আইনে যদি সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয় সেটাও করতে হবে। সেই সঙ্গে সমবায় ব্যবস্থাপনাকে মর্যাদার আসনে নিতে হলে দেশের সকল সমবায় সমিতিগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫০তম জাতীয় সমবায় দিবসের অনুষ্ঠানে সমবায় ব্যবস্থাপনার সুফল কাজে লাগিয়ে পুরো দেশের পরিবর্তন আনা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু সমবায় ব্যবস্থাপনায় নয় সকল প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও মানুষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা উচিত। কারণ এটা করা হলে কাজের পরিধি ও মান বাড়বে।
এদিকে সংসদ সচিবালয় জানায়, গতকালের বৈঠকে মিল্কভিটা দুধের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। বাজারের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে দাম সমন্বয় করে মিল্কভিটার দাম বৃদ্ধির জন্র এই সুপারিশ করা হয়। এছাড়া বৈঠকে আরডিসিএসএল এবং রংপুর বিভাগীয় শহরের সমবায় ব্যাংকের বিষয়ে তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়।
মানবকণ্ঠ/এআই


