প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ঘরমুখী মানুষ

শিডিউল বিপর্যয় দিয়েই ট্রেনে ঈদযাত্রা শুরু


  • সেলিম আহমেদ
  • ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৩৪

‘মন বলে চল ফিরে আবার/স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’-জনপ্রিয় এই গানের কথাগুলো ঈদের সময় আরো আপন করে হৃদয়ে জায়গা করে নেয় রাজধানীবাসীর। গানের কথাগুলোর মতো আপনজনের দেখা পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে গ্রামের পথে ছুটে যান তারা। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। করোনা মহামারীর কারণে গত দুই বছর অনেকেই স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে না পারায় এবার ঘরমুখী মানুষের স্রোত একটু বেশি। তবে মানুষের ঈদযাত্রা মোটেও স্বস্তিকর নয়। টিকিট পাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, সড়কপথে তীব্র জানযট, ট্রেন-লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, বিমানের টিকিট না পাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে নগরবাসীর। এতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। খোদ রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন শিডিউল বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন, প্রতিবারের মতো এবারো ঈদযাত্রায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হবে। ডাবল লাইন না হলে কোনোভাবেই শিডিউল বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

অন্যদিকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে পঞ্চম দিনের মতো ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। ওইদিন দেয়া হয় আগামী ১ মে’র ঈদ যাত্রার অগ্রিম টিকিট। পয়লা মে’র অগ্রিম টিকিট পেতে অনেকেই মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। তবে গত কয়েকদিনের তুলনায় এদিন টিকিটপ্রত্যাশীদের ভিড় কিছুটা কম দেখা গেছে।  স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, আগে থেকেই যাত্রীরা নিজ উদ্যোগে লাইনে দাঁড়ানোর সিরিয়াল লিখে রেখেছেন। সবাই যাতে সিরিয়াল মেনে টিকিট নিতে পারেন-এজন্যই তারা এমনটি করেছেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছেন রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী বা আরএনবি। লাইনের বাইরে কেউ যেতে চাইলেই পেছন থেকে অন্যরা চিৎকার করে বাধা  দেন। এতে কেউ লাইনের আগে যেতে সাহস করছেন না।

আলমগীর মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, খুকু মিয়া বলেন, সড়ক-মহাসড়কে প্রচুর যানজট থাকে। এরপরও বাসের টিকিটের জন্য চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু টিকিট পাইনি। তাই ট্রেনের টিকিটের জন্য দুই বন্ধু স্টেশনেই রাত পার করেছি। একই কথা বলেন অপর টিকিটপ্রত্যাশী বেলাল হুসাইন। তিনি বলেন, এবারের ঈদ যাত্রায় সড়কে প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হবে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আগেই নিউজ দেখেছি। এজন্য বাসের টিকিটের জন্য চেষ্টা করিনি।

সরেজমিনে গতকাল বুধবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৬টায় রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে ঈদযাত্রা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রথম ট্রেনই বিলম্বিত হয়। ফলে ৬টা ২০ মিনিটে সিলেটগামী পারাবত ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ঈদযাত্রা শুরু হয়। আর ধূমকেতু ট্রেনটি ৫৫ মিনিট বিলম্বিত হয়ে ৬টা ৫৫ মিনিটে কমলাপুর ছাড়ে। একইভাবে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ৮টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও বিলম্বিত হয়ে ট্রেনটি ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। এ ছাড়া যাত্রীতে পরিপূর্ণ রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৯টা ১০ মিনিটে কমলাপুর ছাড়ার কথা থাকলেও বিলম্বিত শিডিউল নিয়ে কমলাপুর ছাড়ে সকাল ১০টা মিনিটে।

রেলওয়ে অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবারের ঈদযাত্রায় প্রতিদিন ৫৩ হাজার যাত্রী ট্রেনে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করবেন। এর মধ্যে শুধূমাত্র আন্তঃনগর ট্রেনে আসন থাকবে ২৭ হাজারের বেশি।

কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার দুপুরে জানিয়েছেন, গতকাল থেকে আমাদের ট্রেনের ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। সকালে যে ১২টি ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে এর মধ্যে ২-৩টি ট্রেনের কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ক্রসিংয়ের কারণে মূলত ট্রেনগুলো বিলম্ব হয়েছে। আশা করছি আমাদের বাকি ট্রেনগুলোর টাইম শিডিউল ঠিক থাকবে। আজা সারাদিনে মোট ৩৭টি ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাবে।

এদিকে শুরুতেই শিডিউল বিপর্যয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। আজিজুল ইসলাম নামে সিলেটগামী এক যাত্রী বলেন, আজ (বুধবার) বাড়ি যাচ্ছি পরিবারের সবাইকে নিয়ে। কিন্তু টিকিট পেতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। প্রায় ১৮ ঘণ্টা লাইনে থেকে টিকিট পেয়েছিলাম। ফারজানা আক্তার নামে ধূমকেতু এক্সপ্রেসের এক যাত্রী বলেন, ধূমকেতু ছাড়ার কথা ৬টায়, সেখানে বলা হলো সাড়ে ৬টা। এখন ৬টা ৫০ মিনিট হলো অথচ ট্রেন ছাড়ছে না। সড়কের ভোগান্তি এড়াতে আমরা ট্রেনের ওপর ভরসা করি, রাত-দিন অপেক্ষা করে টিকিট সংগ্রহ করেছি অথচ এখনও ট্রেন ছাড়ছে দেরিতে।

শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নারী-শিশু সঙ্গে নিয়ে আসা ভ্রমণকারীরা। মুহিবুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, ভোরের ট্রেন ধরতে সেহরি খেয়েই স্টেশনে ছুটে এসেছি, কিন্তু এখনও কোনো খবর নেই। গরমের মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে বসে থাকা যায়?

তবে দিনের অন্যান্য ট্রেন চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম অভিমুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জগামী এগারো সিন্ধুর প্রভাতি, দেওয়ানগঞ্জ অভিমুখী তিস্তা এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম অভিমুখী মহানগর প্রভাতি যথাসময়ে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে।

লঞ্চ-স্পিডবোটে ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে, ফেরি সংকটে ভোগান্তি: গতকাল বুধবার সকাল থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রীরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই গত দুই দিন ধরে নারী ও শিশু যাত্রীদের ঘরে ফেরার ভিড় দেখা গেছে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌ-রুটে। তবে গতকাল সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নৌরুটের লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। এরপর দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত যাত্রীদের চাপ কিছুটা কমে আসে। এরপর বিকাল তিনটা থেকে যাত্রীদের ভিড় আবারও বাড়তে থাকে। বিআইডব্লিউটিএর বাংলাবাজার ঘাট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে ফেরি সংকটের কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এই রুটের যাত্রীদের। রুটটিতে আটটি ফেরি থাকলেও এখন পাঁচটি ফেরি চলাচল করছে। পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে আছে যাত্রী ও যানবাহন। সকালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফেরি বেগম রোকেয়া সার্ভিসিং পয়েন্টে চলে যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌ-রুটে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ফেরি চলাচল করছে। মাঝিকান্দি-শিমুলিয়া রুটে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আরও দুটি ফেরি। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে ততোই যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। ফলে এ রুটে ফেরি না বাড়ালে ভোগান্তিতে পড়তে হবে যাত্রীদের। তবে সকাল থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রীদের নদী পার হতে দেখা গেছে।

বাংলাবাজার ঘাট সূত্র জানায়, ঈদকে সামনে রেখে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়ছে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে। শিমুলিয়া থেকে লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো বাংলাবাজার ঘাটে আসছে। যাত্রীচাপ নিয়ন্ত্রণে বাংলাবাজার থেকে প্রায় যাত্রীশূন্য লঞ্চগুলো শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর বাংলাবাজার ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন বলেন, লঞ্চ-স্পিডবোটে যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে এ ভিড় আরও বৃদ্ধি পাবে। যাত্রীচাপ অনুযায়ী রাত ১০টা পর্যন্ত লঞ্চ চালু থাকবে।

বাসও ছাড়ছে বিলম্বে: ট্রেনের মতো বাসও ছাড়ছে বিলম্ব করে। তবে বাস মালিকদের দাবি, পর্যাপ্ত যাত্রী আসছে না। সে কারণে বিলম্বে ছাড়তে হচ্ছে প্রতিটি বাস। যাত্রীর আশায় দেরি করলেও আশায় গুড়েবালি। বাধ্য হয়ে সিট খালি রেখেই বাস ছেড়ে দিতে হচ্ছে। ঈদের আগে এমন যাত্রী সংকট পরিস্থিতি গত ৪০ বছরেও হয়নি বলে দাবি করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল বুধবার গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা যায়, ভোর থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে গাবতলীতে আসতে শুরু করেন অনেকে। তাদের কেউ একা, আবার কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে আসছেন। যাত্রীর ভিড় না থাকায় টিকিট পেতে বেগ পেতে হচ্ছে না। তবে অন্য সময়ের চেয়ে বাড়তি টাকায় দূরপাল্লার বাসের টিকিট সংগ্রহ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের। এছাড়া বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়া হচ্ছে না বলে জানান তারা।

পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে যশোর যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাজিয়া আফরিন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় হল থেকে বের হয়ে গাবতলীতে আসেন। অন্য সময়ের চেয়ে ১৫০ টাকা বেশি দিয়ে গোল্ডেন লাইন পরিবহনের টিকিট নিয়েছেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়েছে, সে কারণে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছি। বেশি ভাড়ায় টিকিট কাটলেও নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়ছে না। সকাল সাড়ে ৯টায় বাস ছাড়ার কথা, ১১টা বেজে গেল। কখন ছাড়বে তা কেউ বলতে পারছে না। জিনিসপত্র নিয়ে কাউন্টারের পাশেই অপেক্ষা করছেন তিনি।

শ্যামলী কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা সূর্য মিয়া বলেন, যাত্রীসংকট, সে কারণে নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। দেরি করে ছাড়লেও সিট খালি রেখে যেতে হচ্ছে। দু/একজন যাত্রী যদি পাওয়া যায়, সে আশায় দেরি করে বাস ছাড়া হচ্ছে। হানিফ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার জাকির মল্লিক বলেন, ঈদের আগে এ সময়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ বাস ছাড়লেও এখন ৫-১০টি সিট খালি রেখেই ২০-২৫টি বাস ছাড়তে হচ্ছে। সকাল থেকে ৫টি বাস ছাড়লেও প্রতিটিতেই সিট খালি রেখে ছাড়তে হয়েছে। গত ৪০ বছরেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও ৪০ সিটের গাড়িতে ২১ জন যাত্রী পাওয়া গেছে। ৩০ মিনিট দেরি করলেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রী পাওয়া না গেলে এই কজন নিয়েই বাস ছাড়তে হবে। তবে তাদের ২৮-২৯ এপ্রিলের সব বাসের টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। 

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar