শনাক্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেপ্তারে ধীরগতির কৌশল
হেলমেট বাহিনী কি লাপাত্তা!
হামলার অগ্রভাগে ছিল জসীম ও জুলফিকারের অনুসারীরা

- শাহীন করিম
- ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:২৬
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী-দোকান কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের টানা দুদিনের সংঘর্ষ ও দুজন নিহতের ঘটনায় জড়িত প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। শতাধিক ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হেলমেট পরিহিত ও দেশীয় অস্ত্রসহ সংঘাতের জড়ানো ওই সব ব্যক্তির অধিকাংশই ছাত্র। হামলার অগ্রভাগে ছিল ঢাকা কলেজের বিলুপ্ত কমিটির ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিন ও সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকারের অনুসারীরা। কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হোসেনকে কোপানো ইমন বাশার জুলফিকারের অনুসারী। শনাক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ ধীরগতির কৌশল নিয়েছে বলে তথ্য মিলছে। যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে চূড়ান্ত অভিযানে যেতে চায় পুলিশ।
যেহেতু ঘটনায় ছাত্রদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। যাতে নিরীহ কেউ কোনোভাবে শাস্তি না পায়। তাছাড়া ঈদকে সামনে রেখে শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করলে পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হতে পারে। তাই কয়েকদিন পর আসামিদের ধরতে একযোগে অভিযান চালানো হবে। সেই সঙ্গে ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়।
একই সূত্র মতে, নাহিদকে রামদা দিয়ে কোপানো ছাত্রলীগ কর্মী ইমনসহ অন্তত চারজনকে ইতোমধ্যে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের নাম রাব্বী ও জহির ওরফে জুয়েল। রাব্বীকে লালমনিরহাট থেকে র্যাব ও জহিরসহ দুজনকে ঢাকা থেকে আটক করেছে ডিবি। এরা সবাই ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তবে ডিবি তাদের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে বলছে, শনাক্ত অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এর বাইরে ঢাকা কলেজের অন্তত তিনজন ছাত্রলীগ নেতাকে ডেকে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন বলেও জানা গেছে। ইতোমধ্যে সেদিনের ঘটনায় জড়িতরা গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এজন্য তাদের কয়েকজন চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে, দাঁড়ি রেখে, চোখে গ্লাস পরে, নিয়মিত পাঞ্জাবি পরে আত্মগোপনের চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে একই সংঘর্ষে নিহত দোকান কর্মচারী মুরসালিনকে আঘাত করার ভিডিও খোঁজা হচ্ছে। সেটি এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেছেন, নিউ মার্কেটে সহিংসতার ঘটনায় যারা চিহ্নিত হবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই সহিংসতার মামলার অগ্রগতির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এখানে দুটি হত্যা কিংবা দুর্ঘটনা যেটাই বলেন দুইটা ঘটেছে, এটা অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘটেছে। মৃত্যু কারো জন্য কাম্য নয়, সে যে-ই হোক। আমরা দেখেছি, একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। এই সূত্রপাত থেকে বৃহদাকার একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, এখানে ছাত্র, ব্যবসায়ী, ছোট ছোট ক্ষুদে দোকানদার তারা এ ঘটনায় লিপ্ত হয়ে যায়।
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র বলেছে, সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে এবং ধারালো অস্ত্র হাতে শুধু ছাত্ররা নন, ব্যবসায়ী-দোকানকর্মী ও হকাররাও অংশ নেন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। আর নাহিদ হত্যায় জড়িত অস্ত্রধারী ছয়জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। তারা সবাই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। ইমন ও শাহাদাৎ ছাড়া বাকি চারজন হলেন কাইয়ুম, সুজন সরকার, শাহীন সাদেক মীর্জা ও কাউসার হামিদ ওরফে সাদা কাউসার।
জানা যায়, সংঘর্ষের সময় যারা ঢাকা কলেজের নেতৃত্ব দেয় তাদের অধিকাংশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা ক্যাম্পাসে আগে থেকেই ‘হিটার গ্রুপ’ নামে পরিচিত। কোনো ঝামেলা হলেই দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা পুরোভাগে থাকেন। হামলার সময় ছাত্রলীগের আরেক কর্মী সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি কাইয়ুম। ভিডিও দৃশ্যে নাহিদকে রড দিয়ে প্রথমে যে দুজন আঘাত করেন তাদের একজন কাইয়ুম। তার পরনে ছিল নীল টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। রামদা দিয়ে কোপায় ইমন।
ঢাকা কলেজের সাবেক ও বর্তমানে একাধিক ছাত্র জানান, ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক মারামারিতে একাধিকবার ইমনকে সামনের সারিতে দেখা গেছে। এর আগে ঢাকা কলেজের সঙ্গে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের সময় দুই শিক্ষার্থীর হাত ভেঙে দিয়েছিলেন ইমন। তদন্ত সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমন আরও অন্তত চার ছাত্রলীগ নেতার নাম-পরিচয় যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তারা হলেনÑ কাওসার হামিদ, শাহীন সাদেক মির্জা, সুজন ইসলাম ও জাকির। কাওসার ও জাকির থাকেন নর্থ ছাত্রাবাসে। শাহীনও একই ছাত্রাবাসের ২১৮ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র।
জানা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। বর্তমানে ১৩৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক ৩৩ জন। মূলত সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়করা ঢাকা কলেজ ও আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে সক্রিয় হলেনÑ বাপ্পী হালদার, ওয়াহিদুজ্জামান বাবু, ফিরোজ হোসেন, জসীম, জুলফিকার ও মিথুন। দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজে কমিটি না থাকায় একক কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এছাড়া ১৩৩ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক নূরে আলম ভূঁইয়া রাজুকে অনেক আগেই বহিষ্কার করা হয়।
জানতে চাইলে ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচএম আজিমুল হক বলেন, নিউ মার্কেটে ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সংঘর্ষে দুই হত্যা মামলা তদন্তে বেশ অগ্রগতি রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজগুলো দেখে প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। অনেকের বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া গেলেও যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হয়েই এ বিষয়ে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে। একটি মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার মকবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই হচ্ছে। একই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের নাম-পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। যেহেতু ঘটনায় ছাত্রদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই তদন্তে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। যাতে নিরীহ কেউ কোনোভাবে শাস্তি না পায়। তবে হত্যায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
উল্লেখ্য, ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। নিউ মার্কেটের দুটি খাবারের দোকানের দুই কর্মীর বিতণ্ডা থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত। এর জের ধরে পরের দিন দিনভর মিরপুর সড়কের নিউ মার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন মার্কেটের দোকান মালিক-কর্মচারী ও হকারদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে মারা গেছেন দুজন (কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন ও দোকানকর্মী মোহাম্মদ মোরসালিন)। আহত হয়েছেন আরো শতাধিক ব্যক্তি।
মানবকণ্ঠ/এআই


