

কুড়িগ্রামে দেখা মিলেছে গল্পের সেই আদু ভাইয়ের। তবে তার নাম মো. দুলু মিয়া (৩৫)। তিনি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের দিয়াডাঙা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি থাকেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের তালুক মশাল গ্রামের একটি কবরস্থানে। অন্যের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলেও গাছপালা বেষ্টিত কবরস্থানই তার পছন্দের জায়গা। রাতে সেখানেই ঘুমান, সকাল হলে পড়াশোনা করতে ছোটেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুলু মিয়ার মা-বাবা দুজনই ছিলেন। তারা মারা গেছেন। তার বাবার নাম মৃত মালু মিয়া। দুলু মিয়ার দুই ভাই ও দুই বোন রয়েছেন। দিয়াডাঙা গ্রামে ছিল তার স্থায়ী বাস। বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পদ ছিল ৪ বিঘা জমি আর বসতবাড়ি। বর্তমানে সেখানে বসবাস করেন তার ছোট ভাই বেলাল মিয়া। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। দুলু মিয়া বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা মারা যাওয়ার আগেই জমি লিখে নিয়েছেন বড় ভাই। মা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ তিনি ঘরছাড়া হন। আশ্রয় নেন তালুক মসাল পাড়া গ্রামের রঞ্জু মিয়ার পারিবারিক একটি কবরস্থানে। ঝড়, বৃষ্টি, শীত কিংবা গরমে ওই কবরস্থানে আলোবিহীন জঙ্গলে বসবাস করেন তিনি। কেউ খেতে দিলে খান। খাবার না পেলে কবরস্থানেই ঘুমান। তবে প্রায় সময় স্থানীয় মো. রঞ্জু মিয়া ও আশরাফুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তির বাড়িতে খেয়ে চলে তার জীবন।
দুলু মিয়ার একটাই কাজ, বিদ্যালয়ে ছুটে চলা। নিজের তৈরি সাইকেল নিয়ে বছরের পর বছর লেখাপড়া করতে ছুটে যান স্কুলে। তার রুটিনে সরকারি ছুটি কিংবা বন্ধের দিন বলতে কোনো শব্দ নেই।
তালুক মসাল পাড়া গ্রামের মো. রঞ্জু মিয়া বলেন, আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি, দুলু মিয়ার মতো এমন মানুষ দেখিনি। কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে আছে। তার সহপাঠীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আর দুলু মিয়া পড়ে আছে একই ক্লাসে। সে প্রতিদিনই নিজের বানানো তিন চাকার ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুল খোলা কিংবা বন্ধের দিন বলতে তার কাছে কিছু নেই। প্রতিদিনই স্কুলে যায় সে।
দুলু মিয়ার ভাই বেলাল মিয়া বলেন, দুলু ভাই কানে কম শোনেন। তার বুদ্ধি কম, তবে ছোটকাল থেকে পড়াশোনা করার আগ্রহ খুব বেশি। বাড়িতে না থেকে তিনি কবরস্থানে থাকেন, আমরা কী করবো। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো তিনি ভালো হতেন।
দিয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. হালিমা খাতুন বলেন, দুলু মিয়া সময়মতো স্কুলে আসেন। স্কুলের বারান্দায় ময়লা, খড়কুটো দেখলে অফিস রুমে ঢুকে ঝাড়ু নিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করেন। নিজেকে খুব পরিপাটি রাখতে পছন্দ করেন তিনি। বেঞ্চ কিংবা মাঠে কোনো ময়লা থাকলে তিনি পরিষ্কার করেন। কানে একদম কম শোনেন। তবে লিখতে পারেন, কোনো কিছু বলতে পারেন না।
তিনি আরও বলেন, দুলু মিয়ার স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম নেই। তবে অনেক বছর ধরে একই (দ্বিতীয়) শ্রেণির বই নিয়ে স্কুল যাওয়া আসা করছেন। ছেলে-মেয়েদের কারো সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেন না। প্রায় ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে পড়ে আছেন দুলু মিয়া।
পাথরডুবি ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সবুর বলেন, আমার ইউনিয়নের ৪ নম্বর তালুক মসাল পাড়া গ্রামে থাকেন দুলু মিয়া। তিনি প্রতিদিনই স্কুলে যান। তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পেলে তার বসবাসের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখবো।
মানবকণ্ঠ/এআই